22/05/2024
অল্প শব্দে জার্মানদের নিয়ে কয়েকটি গল্প (Collected)
৯০ বছর এক বৃদ্ধের কাছ থেকে একটা সাইকেল কিনলাম।
দুইদিন চালানোর পরে রিয়ার চেইন স্পোকেট থেকে শব্দ
আসছে, এমনকি চেইনও মাঝেমধ্যে পড়ে যাচ্ছে। ভাবলাম..
স্পোকেট পরিবর্তন করার আগে, গ্রিজিং করে দেখি।
১| গ্রিজ ওয়েল কিনার জন্য সুপারশপে যাচ্ছি, মাথায় একটা
ব্যপার কাজ করছে.. এই পুরাতন সাইকেলটা না কিনলেই
পারতাম। যাইহোক পথে আমার এক প্রফেসরের সাথে দেখা।
অনেক পুরাতন একটা পেগাসাসের সাইকেল চালাচ্ছে।
সাইকেলের দিকে তাকিয়ে আমি বেশ অবাক হলাম! অথচ
তিনি গত সপ্তাহে Audi Q8 এর বেশ কিছু মডিউল নিয়ে
আলোচনা করেছিল। আমার এই অবাক হওয়ার ব্যাপারটা
চট করে ধরে ফেললো... "তুমি আমার সাইকেলটা দেখে
অবাক হচ্ছো তাই তো?"
-কিছুটা!
-আমার বাবা ১৯৪০ এর দিকে ইস্ট জার্মানিতে থাকতেন।
তখন স্যাক্সনিতে যাতায়াতের অবস্থা খুব ভালো ছিলো না,
বাবা প্রতিদিন ১৮-২০ মাইল সাইকেল চালিয়ে কাজে আসা
যাওয়া করতো। আমি সাইকেল রাইডিং এর সময় বাবাকে
অনুভব করতে পারি, আর এই অনুভব করার ব্যপারটা
আমাকে বেশ শান্তি দেয়, আশা করি বিষয়টা তুমি বুঝেছো?
চাও বলে চলে গেলো, "চাও (Ciao)" শব্দটা আমার জন্য
খুবই দুঃখের, আমি মনে মনে আল্লাহ হাফেজ বলে, ভাবছি..
Audi Q8 এর থেকে শান্তি টা বেশি জরুরি।
২। সুপারশপে গ্রিজ না পেয়ে একটা চকলেট কিনলাম।
এক ৮৫ বছরের (বয়স গুলো অনুমান করে বলা) ইয়াং
মহিলাকে দেখি সেলফ-পেমেন্ট করে, আবার আমার
পিছনে এসে দাঁড়ালো পেমেন্ট করার জন্য। বিষয়টা পরে
বুঝলাম, বাস্কেটে রাখা দুই ঝাক টিউলিপ ফুলের একটা
তখন স্কেন করতে ভুলে গেছিলো। এরজন্য ফিরে এসে
আবার পেমেন্ট করলো। নিঃসন্দেহে বিশ্বাসী ও নিরাপদ
সমাজ ব্যবস্থার মূল কারণ এই সততা।
যাইহোক আমার কৌতুহল আরোও বেড়ে গেলো... উনি
এবং উনার টিউলিপে। সুপারশপ থেকে বার হয়েই
আবার দেখা! হ্যালো বলে, আমি বলেই ফেললাম.. "তোমার
হাতের ফুলগুল অনেক সুন্দর।" আমাকে ধন্যবাদ বলে,
বললো, "ডাস ইস্ট ফুয়া মাইনেন মান" (এটা আমার
হাসবেন্ডর জন্য)। বাক্যটা অনেক সুন্দর না?? তাদের
সম্পর্ক এর ৭০তম এনিভার্সারি। আমি "চুস" বলে, সুপার-
শপের দিকে আবার ফিরে যাচ্ছি। টিউলিপ কিনলাম, নিজের
জন্য। আর ভাবছি.. অথচ "আমার ৭০ দিনও টিকেনি"।
৩। যার কাছ থেকে সাইকেল কিনেছিলাম, তার কাছেই
যাচ্ছি। সামনে ছোট ক্রসিং, ট্রাফিক সিগনাল নেই। আমি
কাছাকাছি যাওয়ার আগেই বাম পাশে একটা Audi A8
থামলো৷ উনাকে আগে যেতে দেওয়ার জন্য আমিও থামলাম।
কিন্তু সে আগে যাবে না। একটা হাসি দিয়ে আমাকে আগে
রাস্তা ক্রস করতে বললো। এই অগ্রাধিকার দেওয়া ব্যাপারটা
আমাকে বিস্মিত করলো।
৪। পথে আরেকজনকে দেখি... Audi E-tron থেকে নেমে
একটা গ্যারেজের সাটার খুলছে। আমি মোটেও অবাক হইনি।
কারণ আমি দেশে থাকতে CBR এ এক্সটার্নাল সাইলেন্সার
লাগিয়ে সেলফ-এডভার্টাইজ করে বেড়িয়েছি। যাইহোক
আসল কথায় আসি, গ্যারেজটা গাড়ি পার্কিং এর না। সাইকেল
মেরামতের গ্যারেজ। ভাবলাম উনাকে দেখাই, যদিও বুঝা
যাচ্ছে এটা উনার প্রফেশন না। আমি বলার সাথে সাথেই
আমার সাইকেলটি চালিয়ে বললো.. "তোমার তো বাইকের
স্পোকেটে সমস্যা, এটা পরিবর্তন করতে হবে। কিন্তু আমি
দুঃখিত আমার কাছে স্পোকেট নেই।"
আমি কাইন প্রবলেম বলে, ভাবছি, ফ্রিতে আমার সাইকেল
দেখে দিলো আবার সরিও বললো! অথচ ৩ বছর আগে
৭০ দিনের সম্পর্কটা সরি বলতে না পারাতেই আত্মহত্যা
করেছিলো।
"তুমি যদি একটা স্পোকেট কিনে আনতে পারো, আমি
তোমাকে লাগিয়ে দিতে পারবো। তবে এটা আমার প্রফেশন
না। আমি শখে এই গ্যারেজটি দিয়েছি৷ আমি সাধারণত
সামারে আমার, এবং আমার ছেলেমেয়েদের সাইকেল
মেরামত করি।"
এবার অনেক কষ্টে "আউফ ভিডাজেন" উচ্চারণ করে
বিদায় নিলাম। আর আমার শখ Audi E-tron থেকে
HorizonJet না তুলে সাইকেল পর্যন্তই ধরে রাখলাম।
৫৷ আমার কাছে সাইকেল বিক্রি করা ভদ্রলোক, আমাকে
দেখে চকমকে উঠলো। আমার গতজীবনের অবজারভেশনে
অভিজ্ঞতা থেকে যা বুঝলাম বেচারা খুব অস্থির অনুভব
করছে। এই অস্থিরতা তৈরি হয়েছে দায়বদ্ধতা থেকে। সাইকেল
নেওয়ার দুইদিন পরেই আমি সমস্যা ফেইস করছি, ব্যাপারটা
উনার মেনে দিতে কষ্ট হচ্ছে। এই দায়বদ্ধতা কিছুটা কমানোর
জন্য, তিনি আমাকে বললো, "তুমি চলে যাও, এটা ফিক্স করতে
আমার বেশ ভালোই সময় যাবে, তুমি তোমার সময়টা অন্য
কোন কাজে ব্যবহার করো। আর আমি এটা ফিক্সড করে
তোমার বাসায় দিয়ে আসবো। তোমার ঠিকানা লিখে দাও।"
আমি নিরুত্তর, কেননা গত জীবনে এমন চমৎকার ভাবে
কাউকে দায়বদ্ধতা কাটানোর চেষ্টা করতে দেখিনি। যাইহোক
জার্মানরা সব কিছুতে টার্মিন (অ্যাপয়েন্টমেন্ট) চায়। এই
সুযোগকে আমিও তাকে একটা টার্মিন দিয়ে আসলাম...
"আপনি কি কালকে সকাল ৯:৩০ এ সাইকেলটি নিয়ে
আসতে পারবেন? আমি এর সময়ের পরে বাসা থাকবো না।"
উনার পারা উচিৎ বলে, আমাকে চলে যেতে বললো। আর
আমি ডাঙ্কেশন বলে বিদায় নিলাম....
৬। বাসে বসে আজকের সারাদিনের কর্মকাণ্ড রি-কল করার
চেষ্টা করলাম। কি এক অদ্ভুত জাতি? একদিনে আমাকে
কত কিছুই লেসন দিয়ে দিলো.. শান্তি, সততা, বিশ্বাস, সম্পর্ক
সখ, অগ্রধিকার দেওয়া, দুঃখিত বলতে পারা, আর দায়বদ্ধতা।
বাসে বসে আমার এই অতি মগ্নতা আমাকে নিয়ে গেলো
বাসের শেষ স্টপেজে। যেটা কিনা আমার বাসার আরোও
দুই স্টপেজ পরে। যাইহোক, এবার আর বাসে উঠলাম না৷
হেঁটেই ফিরা শুরু করলাম। গুগল ম্যাপের শর্টকাট রাস্তা
ফলো করে কবরস্থানের ভিতরে রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। হঠাৎ
আজানের ধ্বনি। আমার একই সাথে আনন্দ আর আতংক
কাজ করছে। আনন্দ! অনেক দিন ধরে আজানের ধ্বনি
শুনি না৷ আর আতংক! এখানে আজান শোনার কথা না।
যাইহোক এটা যে আমার হ্যালুসিনেশন, এটা বুঝতে আমার
কয়েক সেকেন্ডের বেশি লাগেনি। পাশে দেখি.... বেশ
কয়েকজন জার্মান কবরস্থানের পাশে প্রার্থনা করছে।
সমানে একটা বেঞ্চে বসে, আমিও এশা'র নামাজ পড়ে
নিলাম। বাসায় যাচ্ছি, মাথার মধ্যে একটা বিষয় ঘুরপাক
খাচ্ছে... "প্রার্থনাতেই শান্তি, প্রার্থনাই শেষ সম্বল"
✍️রোফায়েল