
05/02/2025
গর্ভাবস্থায় বেশির ভাগ নারীই রক্তশূন্যতায় ভোগেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আয়রনের ঘাটতির কারণে রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। গর্ভাবস্থায় রক্তশূন্যতা গর্ভকালীন জটিলতার অন্যতম কারণ।
এটি বিশ্বব্যাপী একটি স্বাস্থ্য সমস্যা, যা প্রায় ৫০ শতাংশ গর্ভবতী নারীর হয়ে থাকে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে গর্ভকালীন রক্তশূন্যতার জন্য ২০ শতাংশ নারীর মৃত্যু নানা কারণে ঘটে থাকে।
একজন গর্ভবতী নারীর রক্তে যদি হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ১১-এর কম থাকে, সে ক্ষেত্রে এই অবস্থাকে গর্ভকালীন রক্তশূন্যতা বলা হয়।
গর্ভাবস্থায় রক্তশূন্যতার কারণ
সাধারণত গর্ভাবস্থায় রক্তশূন্যতার অনেক কারণ রয়েছে। যেমন-
• গর্ভাধারণের কারণে রক্তস্বল্পতা হতে পারে। কারণ, এ সময় শরীরের জলীয় উপাদান, সেটি বেড়ে যায়। তখন রক্তের লোহিত কণিকা কম তৈরি হয়। সে কারণে রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়।
• আয়রনযুক্ত খাবার কম খেলে রক্তশূন্যতা হয়।
• গর্ভাবস্থায় বমি হওয়াকেও রক্তশূন্যতার জন্য দায়ী করা হয়।
• গর্ভাবস্থার আগে থেকেই রক্তস্বল্পতা থাকতে পারে। গর্ভাবস্থার পরেও এটি বেড়ে গেছে।
• আরেকটি বিষয় ভুল খাদ্যাভ্যাস। অর্থাৎ সুষম এবং সঠিক খাবার না খেলে এটি হতে পারে। এর প্রভাব তো রয়েছেই। এখনকার মায়েরা জাংক ফুডের দিকে বেশি আগ্রহী থাকেন। আমরা স্বাভাবিকভাবেই জানি, লালশাক, কচুশাক, ছোট মাছ, ডিম, শিং মাছ, কাঁচকলা, আনার এসবের মধ্যে আয়রন রয়েছে। গর্ভাবস্থায় অনেকেই এসব খেতে চান না বা খেতে পারেন না।
• ফোলেটের অভাবেও রক্তশূন্যতা হয়। ফোলেট হলো এক ধরনের ভিটামিন বি, যা শরীরে নতুন কোষ তৈরি করতে প্রয়োজন। এটি লোহিত রক্তকণিকা গঠনে সহায়তা করে। গর্ভাবস্থায় ফোলেটের প্রতিদিনের জন্য প্রয়োজন বৃদ্ধি পায়। ফোলেটের অভাবের কারণে স্বাস্থ্যকর লাল রক্ত কণিকার পরিমাণ কমে যেতে পারে। (ফোলেটের অভাবজনিত রক্তস্বল্পতা নিউরাল টিউবের অস্বাভাবিকতা (স্পিনা বিফিডা) এবং জন্মের কম ওজনের মতো মারাত্মক জন্মগত ত্রুটি দেখা দিতে পারে।)
• ভিটামিন বি১২-এর অভাবজনিত রক্তস্বল্পতা দেখা দিতে পারে এ সময়। (কোবালামিন বা ভিটামিন বি১২ লোহিত রক্তকণিকা তৈরির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যে নারীরা তাদের ডায়েটে দুধ এবং অন্যান্য দুগ্ধজাত খাবার, ডিম, মাংস রাখেন না, তারা ভিটামিন বি১২-এর অভাবজনিত রক্তস্বল্পতায় ভোগেন। এতে প্রয়োজনীয় পরিমাণ রক্তের উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়।)
আর আয়রনের অভাবজনিত রক্তশূন্যতা সবচেয়ে পরিচিত। এ ছাড়া লোহিত রক্ত কণিকা সময়ের আগেই ভেঙে গেলে রক্তশূন্যতা হয়। দীর্ঘস্থায়ী নানা রোগ যেমন কিডনি ড্যামেজ বা অকেজো, লিভার অকার্যকর, থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যা, আর্থ্রাইটিস, যক্ষ্মাসহ নানাবিধ রোগে রক্তশূন্যতা হতে পারে।
আরেকটি কারণ হতে পারে হিমোগ্লোবিনের জিনগত রোগ যেমন থ্যালাসেমিয়া। তবে আয়রনের ঘাটতিজনিত রক্তশূন্যতা সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি। এর কারণ হতে পারে অপুষ্টি, পেপটিক আলসার, ব্যথানাশক ওষুধ সেবনের ফলে পাকস্থলীর ক্ষত, কৃমির সংক্রমণ, পাইলস কিংবা রজঃস্রাবের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ইত্যাদি। ঘন ঘন গর্ভধারণ আর স্তন্যদান আরেকটি বড় কারণ।
লক্ষণ
গর্ভাবস্থায় রক্তশূন্যতার কিছু সাধারণ লক্ষণ রয়েছে। সেগুলো হলো-
• ক্লান্তি অনুভব ও দুর্বলতা
• মাথা ঘোরা
• শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা হওয়া
• দ্রুত বা অনিয়মিত হৃদস্পন্দন
• বুক ব্যথা
• হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া
• ঠোঁটের কোণে ক্ষত।
• জিহ্বায় ঘা
এই লক্ষণগুলো প্রাথমিকভাবে হালকা হতে পারে। তবে এগুলো উপেক্ষা করলে পরবর্তীতে ঝুঁকির কারণ হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লক্ষণগুলো আরও খারাপ হতে পারে। তাই এই লক্ষণগুলোর কোনোটি অনুভব করলে অবশ্যই অবিলম্বে একজন ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে।
জটিলতা
অতিরিক্ত রক্তস্বল্পতা অর্থাৎ রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ৭-এর কম হলে মা এবং গর্ভের শিশুর বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে।
• প্রি-একলাম্পসিয়া
• কার্ডিয়াক ফেইলর
• রোগ সংক্রমণ
• প্রসব-পরবর্তী অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ইত্যাদি হতে পারে।
• আর সন্তানের ক্ষেত্রে গর্ভের শিশুর পর্যাপ্ত বৃদ্ধি না হওয়া
• নির্দিষ্ট সময়ের আগে প্রসব হয়ে যাওয়া বা সন্তান প্রিম্যাচ্যুর হয়ে জন্ম নেয়া
• শিশু কম ওজন নিয়ে জন্ম নেয়া ইত্যাদি হতে পারে।
বাচ্চার ওপর প্রভাব
শিশুর সমস্যা
• বাচ্চা মাতৃগর্ভে মারা যেতে পারে
• বাচ্চার বৃদ্ধি ঠিকমতো হবে না
প্রতিকার
• ২১ বছরের নিচে গর্ভধারণ স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তাই ২১ বছর বয়সের গর্ভধারণ থেকে বিরত থাকতে হবে।
• দুটি গর্ভধারণের মাঝে অন্তত দুই বছরের বেশি সময় থাকতে হবে।
• গর্ভধারণের আগে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে হবে।
• রক্তে হিমোগ্লোবিন শতকরা ১০ গ্রামের কম থাকলে চিকিত্সকের পরামর্শ নিতে হবে।
• এ সময় আমিষ, ভিটামিন ও আয়রনসমৃদ্ধ খাবার যেমন কলিজা, মাংস, ডিম, সবুজ শাকসবজি, মটরশুঁটি, শিম, কলা, পেয়ারা, আনার ইত্যাদি বেশি করে খেতে হবে।
• পাশাপাশি ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী আয়রন ট্যাবলেট খেতে হবে।
• কোনো ইনফেকশন থাকলে দ্রুত চিকিত্সা করাতে হবে। গর্ভকালীন নিয়মিত চেকআপ এবং শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতি তিন মাসে অন্তত একবার করে হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা করাতে হবে।
• রক্তস্বল্পতা থাকলে চিকিত্সকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিত্সা করাতে হবে।
• চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী দুইজন রক্তদাতা প্রস্তুত রাখতে হবে জরুরী মুহুর্তের জন্য।
একটি সুস্থ শিশুর জন্মের জন্য প্রধান শর্ত হলো মায়ের পূর্ণ সুস্থতা। তাই মা ও শিশুর সার্বিক সুস্থতার জন্য গর্ভবতী মায়ের সুস্থতা নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক: রক্তরোগ ও ব্লাড ক্যানসার বিশেষজ্ঞ
সহযোগী অধ্যাপক, হেমাটোলজি বিভাগ
ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।