12/05/2025
ডিসমেনোরিয়া ও পেমফিগাস
এক নারীর নারীত্বের অস্বীকৃতি থেকে আত্মধ্বংসের দিকে যাত্রা, এবং হোমিওপ্যাথির মাধ্যমে পুনর্জন্ম
এক ১৯ বছরের কিশোরী এসেছিল আমার চেম্বারে, যার মুখে-পিঠে ও দেহজুড়ে ছিল যন্ত্রণাদায়ক পেমফিগাসের ফোসকা। মুখগহ্বর ও ওরোফ্যারিংক্স পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিল এ রোগ। পাশাপাশি সে দীর্ঘদিন ধরে ভুগছিল তীব্র ডিসমেনোরিয়ায়। প্রতি মাসে মাসিকের সময় এতটাই প্রচণ্ড ব্যথা হতো যে, তাকে বারবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হতো এবং ইনজেকশনের মাধ্যমে ব্যথানাশক দিতে হতো, কারণ ট্যাবলেট সে সহ্য করতো না। টানা তিনটি সাইকেলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল। চতুর্থ মাসে ধীরে ধীরে তার পেমফিগাস শুরু হয়। এই পেমফিগাস চলেছিল প্রায় ৪-৫ বছর ধরে।
চেম্বারে প্রথমবার সে যখন ঢোকে, আমি লক্ষ করলাম সে পরে এসেছে জিন্স আর ফর্মাল বোতাম দেওয়া শার্ট। ডান হাতে পরে ছিল একটি মোটা 'কড়া' (সাধারণত পুরুষরা পরে) এবং অপর হাতে একটি বড়ো, পুরুষালি ডিজাইনের ওয়াচ। তার এই বেশভূষা আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছিল Ammonium carb টাইপ রোগীদের, কিন্তু পরে দেখা গেল এটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের এক মানসিক গঠনের অভিব্যক্তি।
রোগীর মুখে নিজের কথা: “ডাক্তার, আমার মুখের ভেতর ভরে গেছে ঘায়ে। কিছুই খেতে পারছি না, এসিডের মতো পোড়ে। পানি খেতেও পারি না- খালি যন্ত্রণা।"
আমি জিজ্ঞাসা করলাম- "এই সব শুরু হলো কবে থেকে?"
সে বলল- "নবম শ্রেণির পর থেকে।"
আরও জানতে চাইলে সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, "সেই সময়টা আমার জীবনের সবচেয়ে বাজে সময় ছিল। আমার জীবন তো কত সুন্দর ছিল!" "কিন্তু যখন প্রথম আমার মাসিক শুরু হলো, আমি ভেঙে পড়ি। আমি তো ছিলাম ফ্রি বার্ড! আমার পাড়া-প্রতিবেশে আমি ছিলাম টমবয়। ছেলেদের সঙ্গেই খেলতাম, ক্রিকেট, ফুটবল, কাবাডি- আমি একজন স্পোর্টি মেয়ে ছিলাম। মেয়েদের একদম ভালো লাগতো না। কেন জানি না!"
"মেয়েরা সারাদিন শুধু মেকআপ আর গসিপ নিয়েই পড়ে থাকে। আমি এইসব একেবারে সহ্য করতে পারি না। আমার মামারা, বাবা- ওদের সঙ্গে খুব খোলামেলা সম্পর্ক। কিন্তু আমার মায়ের সঙ্গে কখনোই খোলামেলা কিছু বলতে পারি না। কারণ, কিছু বললেই মা কাঁদতে শুরু করে। আমি এই মেয়েলি আবেগ সহ্য করতে পারি না!"
তার কণ্ঠে ঘৃণা, বিরক্তি, অপছন্দ-সবকিছুই স্পষ্ট ছিল।
সে বলল- "মাসিক শুরুর পর থেকে আমার মা বলতে লাগল- ‘তুমি এখন বড়ো মেয়ে, ছেলেদের সঙ্গে খেলাধুলা করা চলবে না’। আমি তো ভাবলাম, কেন? কী দোষ করেছি আমি?? আমার জীবনটা একদম শেষ হয়ে গেল এই ‘মাসিক’ শুরু হবার পর থেকে!"
প্রতীক ও বিশ্লেষণ
এই কিশোরীর ভেতরে এক অদ্ভুত ঘৃণা জন্ম নিয়েছে নিজের নারীত্বের প্রতি, নিজের শরীরের প্রতি, নিজের অস্তিত্বের প্রতি। সে চায় ছেলে হতে, কারণ ছেলেদের কোনো সামাজিক বাধা নেই, ছেলেরা জীবন উপভোগ করে, আর মেয়েরা শুধু গসিপ, আবেগ আর সাজসজ্জা নিয়ে পড়ে থাকে।
এই প্রবল মানসিক সংঘাত তার শরীরেও ছাপ ফেলেছে - প্রতি মাসের ডিসমেনোরিয়া, যা সে মনে করে তার জীবন নষ্ট করেছে। এবং ধীরে ধীরে শরীর নিজেকেই আক্রমণ করছে - অটোইমিউন ডিজিজ - পেমফিগাস।
এই কেসে আমরা দেখি, নিজের নারীত্বের প্রতি ঘৃণা কিভাবে ধ্বংসাত্মক রূপ নেয় - একপ্রকার আত্মধ্বংসের অনবদ্য রূপ।
রেমেডি: Raphanus
এই কেসটি ছিল এক অসাধারণ উদাহরণ যেখানে Raphanus তার প্রকৃত কার্যকারিতা দেখিয়েছে। কারণ এখানে রোগী কেবল ছেলেদের মতো আচরণ করতে চায়নি (যেমনটা দেখা যায় Ammonium carb-এ), বরং সে ছেলেদের সঙ্গ উপভোগ করে, তাদের জীবনযাপন পছন্দ করে, নারীত্বকে ঘৃণা করে।
তার রয়েছে:
নিজের লিঙ্গের প্রতি বিতৃষ্ণা
মেয়েদের প্রতি ঘৃণা
ছেলেদের মতো স্বাধীনতা ও আনন্দের প্রতি আকর্ষণ
নারীত্বকে দুর্বলতা মনে করা
নিজের নারীত্বকে অস্বীকার করা
এগুলি সবই Raphanus-এর গভীর মানসিক রুব্রিকের সঙ্গে মিলে যায়।
ফলো-আপ: নারীত্বের পুনর্জাগরণ।
একদিন সে চেম্বারে এসে প্রথমেই বলল: "ডাক্তার! দেখুন, আমি আজ পাঞ্জাবি ড্রেস পরে এসেছি! আমি সেই বড়ো ঘড়িটা খুলে দিয়েছি, এখন দেখুন এই মেয়েলি ঘড়ি! এই দেখুন আমার দুল - কত সুন্দর, আগে পরতামই না!"
আমি লক্ষ করলাম - তার ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক, মুখে উজ্জ্বলতা, চোখে কোমলতা, আচরণে শোভা ও স্নিগ্ধতা।
সে যেন এক নতুন রূপে আবির্ভূত হয়েছে।
তার নারীত্ব ফিরে এসেছে। এই পরিবর্তন শুধু বাহ্যিক নয় - এটি ছিল এক আত্মিক রূপান্তর। সে আর নিজের লিঙ্গকে ঘৃণা করে না - বরং নিজের নারীসত্তাকে আপন করে নিয়েছে।
উপসংহার
এই কেসটি বহু সেমিনার ও শিক্ষামূলক সেশনে আমি উপস্থাপন করেছি। আমি এই কেসটি আমার বইয়ে সংযোজন করেছি কারণ আমি সকল হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক, অভিভাবক ও সমাজকে সচেতন করতে চাই - মাসিকের সময় বা 'মেনার্ক' হল একজন মেয়ের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রূপান্তরের সময়। এই সময় তার দৃষ্টিভঙ্গি, মানসিকতা ও গ্রহণযোগ্যতা তার ভবিষ্যতের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ভিত্তি তৈরি করে।
একজন মেয়ে যদি তার নিজস্ব নারীসত্তাকে গ্রহণ না করতে পারে, সেটি ধীরে ধীরে দেহ, মনের গভীরে আত্মধ্বংসাত্মক শক্তি তৈরি করতে পারে।
আর সেই আত্মধ্বংসের অন্ধকার থেকে তাকে ফেরাতে পারে একমাত্র হোমিওপ্যাথির পূর্ণাঙ্গ, গভীর ও সম্মানজনক চিকিৎসা।
From: Third Eye Prescription
Dr. Md. Abdul Wahed
H M Homoeo Hall
RC Tower, Uposhahor, Bogura
Mob: 01913375820