29/05/2025
১...
বছর খানেক আগের কথা। ইন্টেরিম গভর্মেন্ট তখনো ক্ষমতায় আসে নাই। ভারতের সাথে সে সময়টায় আমাদের দহরমমহরম সম্পর্ক। এরকম একটা সময়ে আমার এক পেশেন্ট তার রুটিন কিছু চেকআপ করার জন্য ইন্ডিয়ার চেন্নাই উড়াল দিলেন...
ইন্ডিয়া থেকে ফেরত আসার পর আমার সাথে দেখা করতে এলেন। আমার জন্য নানারকম গিফট টিফট আনলেন। সব শেষে জানালেন ইন্ডিয়ান ডাক্তাররা চর্বির ওষুধ বাদে আমার দেয়া আর কোন ওষুধ চেইঞ্জ করেননি। আমার পেশেন্টকে জানানো হয়েছে, উনারা যে ওষুধটা চেইঞ্জ করে দিয়েছেন, সেটা নাকি আরো আধুনিক। আমি চেক করে দেখলাম চেইঞ্জ করা ওষুধটার নাম সিপ্রোফাইব্রেট, আমি দিয়েছিলাম ফেনোফাইব্রেট (Brand name: Fenocap/Nofiate/Fenatrol)...
ভদ্রলোক ডায়াবেটিস + রক্তে অতিরিক্ত চর্বির (ট্রাইগ্লিসারাইড) রোগী। FIELD ট্রায়াল এবং ACCORD ট্রায়াল নামে দুটো বিশ্বখ্যাত স্টাডির উপর ভিত্তি করে আমি উনাকে ফেনোফাইব্রেট ওষুধটা দিয়েছিলাম, যে স্টাডিগুলোতে ডায়াবেটিক পেশেন্টদের রক্তে চর্বি (ট্রাইগ্লিসারাইড) বেশী থাকলে ফেনোফ্রাইব্রেট রেকমেন্ড করা হয়েছে, যেটার মাল্টিপল বেনিফিট আছে...
সিপ্রোফাইব্রেট রিলেটিভলি নতুন ওষুধ। ফেনোফাইব্রেট এর মতো বড় কোন স্টাডি নেই। ইন দ্য লং রান এটা উনার ভালোও করতে পারে, আবার নানাভাবে খারাপও করতে পারে...
শুধুমাত্র ইন্ডিয়া থেকে প্রেসক্রাইব করেছে বলে আমার দেয়া প্রুভেন একটা ওষুধকে ছেড়ে অপেক্ষাকৃত নতুন ওষুধকে উনি যক্ষের ধন মনে করে আঁকড়ে ধরলেন। ইন্ডিয়া থেকে নতুন আধুনিক ওষুধ নিয়ে আসার আনন্দে উনার চোখ চকচক করতে লাগলো। আমি মনে মনে হাসলাম, তেমন কিছু আর বলি নাই। উনার আনন্দটা নষ্ট করতে আমার মন সায় দেয় নাই, ব্যাখ্যা করলেও আসলে কোন লাভ হতো বলে মনে হয় না...
২...
আমার আরেক স্পেশাল রোগীর কথা বলি। ব্যবসায়ী মানুষ, একটু সর্দি কাশি হলেই উনি সিঙ্গাপুর চলে যান। দেশে সাধারণত তেমন কোন ডাক্তারকে দেখান না। মাঝে মাঝে শারীরিক কোন সমস্যা হলে আমাকে ফোন করেন, আমি চেম্বার শেষে রাতে উনার বাসায় চলে যাই...
ভদ্রলোকের ওজন প্রায় ১২০ কেজি। উনারও ডায়াবেটিস। রাতে ঘড়ঘড় শব্দে নাক ডাকেন, মেডিকেলের ভাষায় এটাকে আমরা স্লিপ এপনিয়া বলি। যখনকার কথা বলছি, সে সময়টায় অ্যামেরিকার FDA এই স্লিপ এপনিয়ার জন্য একটা ওষুধ অনুমোদন দিয়েছে, যার নাম Tirzepatide (এমেরিকান ব্র্যান্ড নেইম Zepbound)। ওষুধটা ইন্টারেস্টিংলি আবার ডায়াবেটিসের জন্যও কাজ করে...
আমি ধুমধাম অন্যান্য ওষুধের সাথে Tirzepatide (টিরজেপেটাইড) শুরু করলাম। সপ্তাহে ১ টা করে ইনজেকশন নাভীর গোড়ায় দিতে হয়। চিকিৎসা টিকিৎসা দিয়ে চলে আসার কয়েকদিন পর শুনি উনি আবার সিঙ্গাপুরের টিকিট কেটে দেশ থেকে সাময়িক বিদায় নিয়েছেন । দেশে ফেরত আসার পর জানালেন সিঙ্গাপুরের ডাক্তার উনাকে Semaglutide (সিমাগ্লুটাইড) সাজেস্ট করেছেন। এই Semaglutide টা আসলে আমার দেয়া Tirzepatide এরই জাতভাই...
Semaglutide এর কথা আমিও জানতাম। তবে উনাকে Semaglutide এর জাতভাই Tirzepatide দেয়ার স্পেসিফিক কারণ ছিলো দুইটা:
১.ডায়াবেটিসটাকে ফুল কন্ট্রোল এ রাখা, ভদ্রলোকের ডায়াবেটিস কিছুটা আনকন্ট্রোলড ছিলো (Semaglutide ডায়াবেটিস কন্ট্রোল করে, তবে Tirzepatide এর মত না, এক্ষেত্রে টিরজেপেটাইড আরো এগিয়ে)
২.ওজনটাকে ভালো একটা পরিমাণে কমিয়ে নিয়ে আসা। এতে করে স্লিপ এপনিয়া বা নাক ডাকা সমস্যারও সহজ সমাধান হয়ে যেতো (Semaglutide মাত্র ১১-১২ কেজি ওজন কমায়, যেখানে আমার দেয়া Tirzepatide প্রায় ২২ কেজি পর্যন্ত ওজন কমাতে পারতো)
যাই হোক, আমার দেয়া চিকিৎসা উনার ভালো লাগে নাই। ডলার খরচ করে বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা যিনি নেন, উনার কাছে আমার চিকিৎসা ভালো না লাগাটাই স্বাভাবিক। আমি উনার ভুলটা ভাঙ্গাতে পারতাম, তবে কেন যেন প্রয়োজন বোধ করলাম না...
৩...
আমার কাছে এরকম আরো ভারিভুরি উদাহরণ আছে, সেগুলো এখন আর বলতে চাচ্ছি না। আমার উপরের লেখা থেকে মনে হতে পারে বাংলাদেশে সবক্ষেত্রে ইন্ডিয়া-সিঙ্গাপুর থেকে ভালো চিকিৎসা হয়। আসলে বিষয়টা সেরকম না...
ইন্ডিয়া-সিঙ্গাপুর এগুলো পৃথিবীর বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। জটিল রোগবিদ্যা এবং হাইটেক ইনভেস্টিগেশনে এরা বাংলাদেশ থেকে ডেফিনিটলি অনেক এগিয়ে। এ নিয়ে আমার দ্বিমত নাই...
তবে আমি যে উদাহরণগুলো দিলাম, সেরকম সাধারণ রোগবিদ্যা কন্ডিশনে বাংলাদেশ, ইন্ডিয়া, সিঙ্গাপুরের মাঝে তেমন কোন বেশকম নাই। বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসার জন্য যত লোক দেশের বাইরে যায়, নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি এদের ৭০-৮০ ভাগেরই দেশের বাইরে যাবার কোন প্রয়োজন ছিলো না...
৪...
চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যারা যান, উনারা আসলে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উপরে বীতশ্রদ্ধ হয়েই দেশের বাইরে পা রাখেন। এক্ষেত্রে তারা সবচেয়ে বড় যে ভুলটা করেন, সেটা হলো--তারা তাদের শারীরিক সমস্যার জন্য ঐ বিষয়ের সবচেয়ে বড় বিশেষজ্ঞের খোঁজ করেন, ঐ সাবজেক্টের সবচেয়ে বিখ্যাত ডাক্তারকে দেখাতে চান...
বিখ্যাত ঐ ডাক্তারের সিরিয়াল থাকে দৈনিক ৭০ থেকে ৮০ বা তারো বেশী। কাজেই ঐ চিকিৎসক রোগী প্রতি সময় কম দেন, রোগীর কথা শোনা সম্ভব হয় না এবং অবধারিতভাবে সেখানে রোগগুলো মিস হয়, চিন্তাভাবনা বা ক্যালকুলেট করে ওষুধ দেয়াটা সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। এতে করে মিসহ্যাপসগুলো ঘটে, রোগীরা ফ্রাসটেইটেড হয়ে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে গালিগালাজ করে বিদেশে চলে যান...
খুব সরলভাবে এর সমাধান বলে দেই:
"শারীরিক যেকোন সমস্যার জন্য স্থানীয়ভাবে একজন নির্ভরযোগ্য অভিজ্ঞ এমবিবিএস ডাক্তারকে দেখান। যদি বিশেষজ্ঞ দেখানোর প্রয়োজন হয়, তবে স্থানীয়ভাবে কোন বিশেষজ্ঞকে দেখাবেন। যদি নতুন বিশেষজ্ঞ হয়, তবে আরো ভালো। এদের রোগী কম থাকে, বিশেষজ্ঞ পরীক্ষাতে রিসেন্ট পাশ করায় এদের স্কিল ও মেমোরী থাকে দুর্দান্ত। এরা সময় নিয়ে আপনার কথা শুনবে, যেটা রোগ ধরার জন্য অপরিহার্য। এরা আপনাকে কেন কি ওষুধ দেয়া হয়েছে সেটা ব্যাখ্যাও করবেন, না করলে আপনি নিজে সেটা জিজ্ঞেস করে নিতে পারবেন। ৮০-৯০% রোগীর সমস্যা এভাবে এখানেই সমাধান হয়ে যাবার কথা। যদি না হয়, তবে ঐ নতুন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারই আপনাকে বিখ্যাত কোন বিশেষজ্ঞকে দেখাতে বলবেন বা রেফার করবেন..."
আমার এ কথার অন্যথা করা যাবে না, যদি করেন তবে আমি নিশ্চিত যে আপনাকে নানাভাবে ভুগতে হবে...
৫...
আজকে বিবিসিতে একটা খবর প্রকাশিত হয়েছে। প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৮ লাখ লোক চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাড়ি জমান। এর মাধ্যমে দেশ থেকে প্রায় ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার দেশের বাইরে চলে যায়। চা খেতে খেতে খবরটা পড়ছিলাম, মনটা বিষন্ন হয়ে গেলো। ছোট অর্থনীতির একটা দেশের জন্য খবরটা খুব একটা সুখকর কিছু না। রোগী এবং চিকিৎসক -উভয়পক্ষ সচেতন হলে এই অপ্রয়োজনীয় খরচটা অনেকটাই কমিয়ে আনা যেতো, রুগ্ন দেশমাতৃকাও আরেকটু স্বাবলম্বী হতে পারতো...
জামান এলেক্স ভাইয়ের লেখা