17/05/2025
স্বাস্থ্যসচেতনতা মূলক পোস্ট
Dr Belal Ali
প্রেশার বেশি থাকলে শরীরে কি কি উপসর্গ ( Symptoms)দেখা দেয়?
আপাত সহজ এই প্রশ্নটির উত্তর - গুগল, মায়ো ক্লিনিক, ওয়েব এমডি, প্রফেসর, ইঞ্জিনিয়ার, চার্টার্ড আ্যকাউন্ট্যান্ট,পুলিশ অফিসার, সদাগারি অফিসের কেরানি, ওষুধ দোকানের রবুল, থেকে শুরু করে ঠেলাওয়ালা, রিকশাওয়ালা, পাড়ার মুদি দোকানের জব্বার, চা দোকানের লতিফ চাচা, ধোপা, নাপিত সহ সবাই জানে! এবং শুধু যে জানে তাইই না, সুযোগ দিলে একদম হাতে নাতে প্রমাণ ও করে দেবে!
আশ্চর্যজনক ভাবে এই প্রশ্নের উত্তরটা জানে না শুধুমাত্র এক্টাই প্রফেশনের লোকেরা - ডাক্তাররা!
এবার আসি উত্তরে -
" প্রেশার বাড়লে মাথা ঘোরে" ( ধারণা)
" আমার তো কোন অসুবিধা হচ্ছেনা, তাহলে প্রেশারের ওষুধ খাব কেন?" ( সিদ্ধান্ত)
প্রথম ধারণা এবং দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত - শুধুমাত্র এই দুটো জিনিসের যুগলবন্দীতে হাজার হাজার ফ্যামিলিকে আমি ধ্বংস হতে দেখেছি।
বেশিরভাগ মানুষ জানেইনা তার প্রেশার আছে নাকি - কেননা তার তো আর মাথা তো ঘোরে না! ( যেটা ধ্রুবসত্যের ন্যায় প্রেশারের কারণে ঘোরার কথা ছিল!)
জীবনে প্রথমবার প্রেশার ডিটেক্ট হয় - হাসপাতাল /মেডিক্যাল কলেজের ইমার্জেন্সিতে অচেতন অবস্থায় স্ট্রেচারে করে আসার পর!
তারপরের সিনারিও মোটামুটি এরকম -
ডাক্তারঃ প্রেশার ছিল আগে থেকে, কোন ওষুধ খেতেন উনি?
কিছু রোগির বাড়ির লোকঃ না, ডাক্তারবাবু প্রেশারের তো কোন লক্ষ্মণ ছিলনা, কোনদিন বোঝাই যায়নি প্রেশার আছে ( যেন বোঝার কতরকম উপায় ছিল!)
অন্য কিছু রোগির ( Defaulter) বাড়ির লোকঃ মাঝে মাঝে খেত যখন প্রেশার বেড়ে যেত!
এই উত্তর শোনার পরে ডাক্তারের নিজের প্রেশার এতো বেড়ে যায় সে কহতব্য নয়!
ডাক্তারঃ ওনার কি '24 hour Ambulatory Blood Pressure মনিটরিং' - লাগানো থাকতো নাকি?? - প্রেশার বেড়ে গেলে বুঝতেন কিভাবে?
দ্বিতীয় গ্রুপ ওফ পেশেন্টের বাড়ির লোকঃ না, ওই মাথা টাথা যখন ঘুরতো, তখন আবার ওষুধ খেত!
রাগান্বিত ডাক্তারঃ খুব ভালো করত! এখন মাথায় রক্ত জমে গেছে, অপারেশন করতে হবে, পিজি নিয়ে যান!
অতঃপর অতি দ্রুততার সাথে পিজি গমন এবং ৯৯ ভাগ ক্ষেত্রে ততোধিক দ্রুততার সাথে -
" Regrett, No bed vacant... Ref to SNPH/KPH/CNMC/ Any other govt. Hospitals " স্ট্যাম্প মারা একটি টিকিট নিয়ে অন্য হাসপাতালে যাওয়ার প্ল্যান করা এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আবার ব্যাট হয়ে ফেরত এসে অকূলপাথারে পড়া!
এমতাবস্থায় মুশকিল আসানে আ্যম্বুলেন্স ড্রাইভারের আবির্ভাব - এদের সবসময় তাড়া থাকে - আম্বানি, আদানি, প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতির থেকেও এদের সময়ের দাম অনেক বেশি - এবং সবসময় এরা একটা "ভালো নার্সিংহোম" এর কথা জানে!
অতঃপর সেই নার্সিংহোমে গমন - এবং রোগি যদি ২-৩ দিনের মধ্যে মারা যায় তাহলে নিম্নবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষে খুবই ভালো!
কিন্তু যদি মরা বাঁচার মাঝে ত্রিশঙ্কু অবস্থায় কাটিয়ে দেয় বেশ কিছুদিন - তাহলে বাড়ির লোকের সর্বশান্ত হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই।
আর এই সমস্ত কিছু শুধুমাত্র একটাই ভুল ধারণার কারণে -
"প্রেশার বাড়লে মাথা ঘোরে!"
একটা ভুল ধারণা একটা ফ্যামিলিকে পুরোপুরি শেষ করে দিতে পারে কেননা মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটা ফ্যামিলিকে নিম্নবিত্তে পরিণত করতে - একটা হসপিটাল বিল ই যথেষ্ট!
গতকাল ও যে মানুষটি আপনাকে ভালবাসা দিয়েছে, স্নেহ করেছে আজ হঠাৎ সে আর আপনাকে চিনতেও পারছে না, তার কোন মমতা আপনাকে আর আর্দ্র করছেনা -
হঠাৎ ঘটা এ অসুখে বেঁচে গেলেও সে যেন এক অচেনা মানুষ! বাড়ির লোকের কাছে মূর্তিমান বোঝা!
অতর্কিত অসুস্থ করে ফেলা এ রোগটির নাম ''স্ট্রোক''।
ধনী-গরীব, তরুন-বৃদ্ধ নিমেষেই মারা যেতে বা বেঁচে থেকেও নির্জীব হয়ে যেতে পারে এ রোগে।
স্ট্রোকের কারণ এবং ধরণ বিবিধ - ডিটেইলস আলোচনার স্কোপ এখানে কম, সবথেকে মারাত্মক এবং খুব সহজেই প্রতিরোধ করা যায় যেটাকে সেটা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যেই আমার আজকের এই পোস্ট -
হেমারেজিক স্ট্রোক ডিউ টু হাইপারটেনশন ( প্রেশার)।
আকস্মিক স্ট্রোকের ধাক্কায় ফ্যামিলিকে নিয়ে পথে বসে যেতে না চাইলে নিচের খুব সহজেই এবং একদমই স্বল্প খরচে করা যায় এমন প্রতিরোধের উপায়গুলো ফলো করতে পারেন -
১. পরিবারের সকল সদস্য যাদের বয়স ৩৫ পেরিয়েছে তাদের প্রেশার নিয়মিত ব্যবধানে চেক করতে থাকুন ( অন্তত বছরে একবার, ৬ মাস অন্তরে হলে আরো ভালো হয় এবং একটা ডায়েরিতে তারিখ দিয়ে লিখে রাখুন) - কারও মাথা ঘুরুক বা না ঘুরুক, অন্য কোন অসুবিধা হোক বা না হোক, অন্যকোন রোগ থাকুক বা না থাকুক - মনে রাখবেন প্রেশার হচ্ছে সাইলেন্ট কিলার, এর কোন রকম কোন উপস্বর্গ নেই, অন্তত বড় বড় ডাক্তারি বইতে আমি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পাইনি!
"প্রেশার বেড়ে গেলে মাথা ঘোরে" এবং " আমার প্রেশার বেড়ে গেলে আমি বুঝতে পারি"
এর চেয়ে ধ্রুব মিথ্যা এই পৃথিবীতে দ্বিতীয় আর একটিও নেই!
যাচাই করতে গুগলের সাহায্য নেবেন না, ডাক্তারিটা অতোটা সহজ বিষয় নয় - মনে করে দেখুন আপনার এলাকার সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র বা ছাত্রীটি একের পর এক কঠিন পরীক্ষা দিয়ে পাশ করার পরেই ডাক্তার হয়েছে - সুতরাং তার মেধার উপর ভরসা করুন।
স্ক্রিনিংয়ে প্রেশার বেশি এলে তার সাহায্য নিন। নর্ম্যাল বা কম এলে ৬ মাস ব্যবধানে চেক করতে থাকুন - এটা খুব সহজেই করা যায় এবং বিশেষ কিছু টাকাপয়সাও লাগেনা এর জন্য।
২. যাদের প্রেশার বেশি আছে - বা যাদের ফ্যামিলি তে কারও প্রেশার আছে - তারা লবণ খাওয়া কম করুন, মোটামুটি ভাবে রেকমন্ডেশান হচ্ছে ৫ গ্রামের থেকেও কম লবণ খাওয়া যাবে সারাদিনে ( কাঁচা, ভাজা,সেদ্ধ সবরকম লবণ মিলিয়ে!)
৩. "প্রেশারের ওষুধ একবার খাওয়া শুরু করলে সারাজীবনই খেয়ে যেতে হবে" - এই গ্রুপের অসংখ্য রোগি আমি পেয়েছি - এনাদের নিয়ে যে কি করি - আজ পর্যন্ত ভেবে পেলাম না!
শুধু জিজ্ঞেস করি - " আপনার কাছে, অন্যকোন বিকল্প কোন পথ আছে লাইফস্টাইল মডিফিকেশন এবং ডায়েটারি চেঞ্জেস ছাড়া? কোন তাবিজ/ কবচ/ গাছ-পালা? কলা গাছের রস?"
ওষুধ শুরু এবং কন্টিনিউ করতে হবে কিনা সেটা নির্ভর করবে আপনার বেসলাইন প্রেশার কত তার উপর। প্রেশার যদি অনেকটাই বেশি থাকে সেক্ষেত্রে শুধু লাইফস্টাইল / ডায়েট/ ওয়েট কন্ট্রোলে প্রেশার কন্ট্রোল হবেনা - এগুলোর সাথে সাথে ওষুধ শুরু করতে হবে - সিদ্ধান্ত নেবেন আপনার ডাক্তারবাবু, আপনি নন।
এইখানে ড্যাশ ডায়েট ( DASH Diet - Dietary Approach to Reduce Systolic Hypertension) ফলো করতে পারেন - এটা গুগল করে নিন - কোন ক্ষতি নেই! ( পাতি বাংলায় - কম লবণ, শাক সবজি, ফল মূল বেশি বেশি/ মাছ মাংস, তেল, চর্বি, প্যাকেজড ফুড, জাঙ্কফুড কম)।
৪. যাদের প্রেশার বেশি আছে এবং যারা ওষুধ অলরেডি খাচ্ছেন - তারা কন্টিনিউ করুন এবং মাঝেমাঝেই প্রেশারটা মাপান এবং সেগুলো নোট রাখুন কোথাও - ওষুদের কার্যকারিতা দেখার জন্য - প্রেশার ঠিকঠাক কন্ট্রোল আছে নাকি দেখার জন্য।
যদি দেখেন ওষুধ খাওয়া সত্ত্বেও প্রেশার নর্ম্যাল হচ্ছে না - তাহলে সেক্ষেত্রে আপনার প্রেশারের ওষুধের ডোজ বাড়াতে হবে বা নতুন কোন শ্রেণির আ্যন্টি হাইপারটেন্সিভ ড্রাগ ( প্রেশারের ওষুধ) যোগ করতে হবে - যেটি করবেন আপনার ডাক্তারবাবু আপনার অন্যান্য কি কি কো-মর্বিডিটিস বা রোগ আছে তার উপর নির্ভর করে।
প্রেশার বেশি থাকলেও শরীরে তাৎক্ষণিক কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়না কেন?
মনে করুন আপনি পাথর বইবার একটা ১৬ চাকা ট্রাক কিনলেন যার বহন ক্ষমতা ১০ টন - এখন আপনি যদি তাতে ওভারলোড করে ১৭ টন পাথর চাপান - তাতে কি গাড়ি আর চলতে পারবেনা নাকি প্রথম দিনেই তার টায়ার বার্স্ট করবে??
এক্ষেত্রেও গাড়ির চলতে কিন্তু কোন অসুবিধাই হবেনা- কিন্তু ওভারলোডের কারণে টায়ারের বিট বেশি বেশি করে ক্ষয় পেতে থাকবে - তাতেও গাড়ির চলতে কোন অসুবিধা হবেনা - এমন চলতে চলতে হঠাৎ একদিন টায়ার বার্স্ট করবে বা পিছলে গিয়ে কোন আ্যক্সিডেন্ট করে বসবে।
প্রেশারের কারণেও শরীরে একই জিনিস ঘটতে থাকে - এন্ড অর্গান ড্যামেজ - হঠাৎ কোনদিন স্ট্রোক এবং সেই প্রথমে লেখা ঘটনার পুনরাবৃত্তি! সুতরাং প্রেশারকে হাল্কা ভাবে নেবেন না।
"প্রেশার কমে গেলেও ওষুধ খেয়ে যেতে হবে?" -
হ্যাঁ, খেয়ে যেতে হবে, হয়তো ডোজ রিডাকশন লাগতে পারে- কতটা কম আছে তার উপর নির্ভর করে।
স্ট্রোকের চিকিৎসায় চিকিৎসাবিজ্ঞান বেশ এগিয়েছে। তারপরও চিরন্তন সত্য হলো ''Prevention is better than cure''। একবার বড়মাপের স্ট্রোক হয়ে গেলে যা কিছুই করেন না কেন আগের স্বনির্ভর জীবনটা ফিরে পাওয়া যাবেনা, আপনার ব্যবসা, বাণিজ্য, আয় - ইনকাম সবকিছুই হারিয়ে যেতে পারে।
আর ছোট স্ট্রোক হয়ে গেলে ধরে নিতে হবে আরো আরো স্ট্রোক আপনার অপেক্ষায় আছে।
প্রতিরোধ বা prevention তাই যে কোন পর্যায়েই জরুরী। বিশ্বে প্রতি ৬ জনের একজন জীবনের যে কোন পর্যায়ে এসে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মারা যাবে বা দীর্ঘদিন পঙ্গু হয়ে থাকবে।
অথচ জীবনাচরণ ও খাদ্যাভ্যাসের কিছু নিয়মকানুন ও নিয়মিত ওষুধ খেলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ স্ট্রোক থেকে নিজেকে ও স্বজনদের বাঁচানো যায়।
সুতরাং নিজে ডাক্তারি না করে আপনার ডাক্তারবাবুকে ডাক্তারিটা করতে দিন - নিয়মিত ওষুধ খেয়ে যান- নিজে বাঁচুন - আপনার ফ্যামিলিকে বাঁচান।
Doctor Belal Ali...MBBS, MD ( Medicine), CCEBDM ( Diabetes), Senior Resident...SSKM Hospital ( উপরে উল্লেখিত পিজি হাসপাতাল!)....