12/01/2025
১...
রোগী দেখছিলাম। রোগীর কিডনীর অবস্থা তেমন সুবিধার না, ক্রিয়েটিনিন 2.4। এক্সামিন করে পেটে হাত দিয়ে বুঝলাম বেচারার কিডনীর সাইজটা বড়, মেডিকেলীয় টার্ম PKD. এটার জন্যই মূলত ক্রিয়েটিনিনটা বেড়ে যাচ্ছে, প্রেসারটাও তাই কন্ট্রোলের বাইরে...
আল্ট্রাসনোগ্রাম করে নিয়ে আসতে বলললাম ধানমন্ডির এক হাসপাতালের এক ম্যাডামের কাছ থেকে। ম্যাডামের কাছে যতগুলো রোগী পাঠিয়েছি, সব রোগীই এসে বলেছে যে ম্যাডামের আচরণ ভালো না। কিন্তু এরপরেও আমাকে তার কাছে পাঠাতে হয়, ম্যাডামের আচরণ যেমনই হোক, উনার করা আল্ট্রাসনোগ্রাম অদ্ভুত সুন্দর! উনার রিপোর্টের উপর আমার যথেষ্ট আস্থা রয়েছে...
যাই হোক, ভদ্রলোক সেখান থেকে আল্ট্রাসনোগ্রাম না করিয়ে স্থানীয়ভাবে কোন এক আউলফাউল জায়গা থেকে আল্ট্রা করিয়ে নিয়ে আসলেন, যথারীতি রিপোর্টে সবই নরমাল, কিডনীর সাইজও নাকি ঠিকই আছে...
আমার মেজাজ খারাপ হলো। আমি শতভাগ নিশ্চিত কিডনীর সাইজ বড় (PKD)। রিপোর্টে সেটা পেয়ে গেলে আমার জন্য সুবিধা হতো, PKD তে প্রেসারের ওষুধ বেশ বিবেচনা করে দিতে হয়। এখন আমার আর সে সুযোগ নেই...
রোগীকে জিজ্ঞেস করলাম, পরীক্ষাটা যেখানে করতে বলেছি, সেখানে কেন করান নি। উনি রহস্যময় হাসি দিলেন যার অর্থ আমি কমিশনের ধান্ধায় আল্ট্রাসনোগ্রামটা নির্দিষ্ট জায়গায় করতে বলেছি, উনি অন্য জায়গায় করাতে আমার ধান্ধাটা সফল হয়নি...
আমি আর তেমন কিছু বললাম না, এভারেজ একটা চিকিৎসা দিয়ে রোগীকে বিদায় দিলাম...
২...
আরেক রোগীর কথা মনে আছে। পায়ের রানের এখানে বেশ বড় একটা টিউমারের মত। আমার কাছে সুবিধার লাগলো না। কিছু সিগন্যাল আছে যে এটা ক্যান্সার। রোগীকে আকার ইঙ্গিতে বোঝালাম যে আমি খুব ভালো কিছু আশা করছি না...
এসব ক্ষেত্রে ঐ টিউমারের একটা অংশ সুঁই দিয়ে কালেকশন করে এক্সপার্ট হিস্টোপ্যাথোলজিস্ট এর সাহায্য নিয়ে মতামত রেডী করতে হয়। রোগীকে আবারো ধানমন্ডির একটা ল্যাবে গিয়ে রিপোর্টটা করে নিয়ে আসতে বললাম...
উনি সেটা করলেন না। এক আলতুফালতু জায়গা থেকে রিপোর্ট করে নিয়ে আসলেন, রিপোর্টে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিলো না, অগাবগা জায়গার আবোলতাবোল রিপোর্ট। রোগী এবং তার লোকজনের চোখে আমাকে নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য বুঝতে পারলাম। তাদের ধারণা আমি একটা নরমাল জিনিসকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড় করে তুলেছি...
এই তুচ্ছতাচ্ছিল্যর প্রায়শ্চিত্ত অবশ্য তাদের করতে হয়েছিলো। শেষ খবর অনুযায়ী ভিটেমাটি বিক্রি করে কেমোথেরাপি দেবার জন্য ইন্ডিয়া পর্যন্ত যেতে হয়েছিলো। এরপর আর আপডেট পাইনি...
অথচ এই রোগীর ক্যান্সারটা আগেভাগে ডায়াগনোসিস করতে পারলে অনেক কিছুই হয়তো করা যেতো...
৩...
এবার থাইরয়েডের এক রোগীর কথা বলি। হাইপোথাইরয়েডের রোগী, থাইরক্সিন জাতীয় ওষুধ খাচ্ছেন। কিছুদিন পরপর উনি লোকাল এক অখ্যাত ডায়াগনস্টিক থেকে TSH করিয়ে আমার কাছে আসেন...
এই ধরণের থাইরয়েডের রোগীদের ৬ মাস পরপর TSH পরীক্ষাটা নিয়মিত করতে হয়। TSH পরীক্ষা করানোটা বেশ সেনসিটিভ একটা ইস্যু, সবসময় একটা পার্টিকুলার টাইমে, দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়ে পরীক্ষাটা করাতে হয়, দিনে-রাতে রিপোর্টে পার্থক্য হয় । আরেক হ্যাপা হলো সেন্টার টু সেন্টার এটার রিপোর্টে বেশ ভ্যারিয়েশন দেখা যায়। আমি সবসময় এই ধরণের পরীক্ষাগুলো কয়েকটি নির্দিষ্ট জায়গায় করাতে বলি, যেমন:
--পরমাণু শক্তি গবেষণা কেন্দ্রগুলো
--CMH
--ICDDR'B
কুখ্যাত ঐ ডায়াগনস্টিকটিতে ভদ্রমহিলার রিপোর্ট প্রতিবারই নরমাল আসে। অথচ আমি পরিষ্কার ক্লিনিক্যালি বুঝতে পারছি যে রিপোর্ট ঠিক নেই, ওষুধের ডোজ এডজাস্ট করতে হবে। রোগীর হাজব্যান্ড আমার কথাকে পাত্তা দেন না, আমার নির্দেশিত জায়গায় উনি পরীক্ষা করান নি...
এই মহিলাকে একটা পর্যায়ে অজ্ঞান অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়, ঐ সময়টায় আমি হাসপাতালে ছিলাম না, রোগীকে পরবর্তীতে ঢাকা মেডিকেলে রেফার করা হয়। ডোজ এডজাস্ট না করতে পারায় মোস্ট প্রবাবলি মহিলাটি এক জটিল থাইরয়েড কন্ডিশনে চলে গিয়েছিলো, যাকে আমরা মিক্সিডিমিক কোমা বলে থাকি...
উনারা যদি আমার নির্দেশিত জায়গায় পরীক্ষাগুলো করাতেন, তবে হয়তো এই জটিল পরিস্থিতি এভয়েড করা যেতো। কে শোনে কার কথা!...
৪...
একটা সময় ছিলো যখন রোগীদের খুব করে বোঝাতাম, কোন পরীক্ষা কোথায় করাতে হবে, কোথায় কোন পরীক্ষা করা যাবে না। এখন আর এসব বলি না, যার পেছনে কারণ তিনটা...
প্রথমত, বাঙালি জাতিগতভাবে সন্দেহপ্রবন। নির্দিষ্ট জায়গায় পরীক্ষা নীরিক্ষার কথা বললে উনাদের সন্দেহপ্রবণতা উসকে উঠে। চিকিৎসকদের কিছু অনৈতিক কার্যকলাপও অবশ্য এ অবস্থার জন্য দায়ী...
দ্বিতীয়ত, কিছু কিছু ডায়াগনস্টিক রীতিমতো মাফিয়াতে রুপান্তরিত হয়েছে। আমার জানা আছে কোন্ কোন্ ডায়াগনস্টিক স্ট্যান্ডার্ড না। এটার কথা রোগীকে বলে বিপদে পড়তে হয়।এসব কথা বলার জন্য একবার আমার এক কলিগকে তো এক ডায়াগনস্টিক এর লোকজন তুলে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো। কি দরকার নিজের বিপদ ডেকে আনবার...
তৃতীয় কারণ হলো, এখন আস্তে আস্তে বয়স হচ্ছে। আমি জানি কিছু মানুষকে আপনি কখনোই আপনার ভ্যালিড রিজন এক্সপ্লেইন করে বোঝাতে পারবেন না, তারা তাদের মতোই কাজ করবে, এটা অনেকটা তাদের জেনেটিক মেকআপ।Everybody is paid back by his own coin, যারা কথা শোনেনা, তারা তাদের মত করে কর্মফল ভোগ করবে--এটাই প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম, প্রকৃতির সেই নিয়মকে অগ্রাহ্য করার আমি কেউ না......
জামান অ্যালেক্স