07/01/2018
এলার্জী, সমস্যা ও প্রতিকার
অনেকের ধারণা চর্মরোগ মানেই এলার্জী। অথচ হাজারো চর্মরোগের মধ্যে এলার্জী হচ্ছে শুধু এক ধরনের রোগ। এলার্জী শব্দটি সকলের কাছে অতি পরিচিত হওয়া সত্বেও এনিয়ে এ ধরনের ভুল ধারনার শেষ নেই। সাধারণ ভাবে বলতে গেলে, এলার্জী অর্থ হচ্ছে-সহ্য করতে না পারা। আমরা অনেক সময় তাই কথায় কথায় বলেও থাকি অমুকে আমার এলার্জী অর্থাৎ আমি অমুককে সহ্য করতে পারি না। ঠিক একই ভাবে, কারো শরীর বা ত্বক যদি নির্দিষ্ট কোন কিছুকে সহ্য করতে না পারে অর্থাৎ ঐ জিনিষের সংস্পর্শে এলেই যদি তার শরীর বা ত্বকে কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়, তাহলে ঐ জিনিষটি তার শরীরে এলার্জীক বলে ধরে নিতে হবে।আর তার প্রতিফলন হিসেবে ত্বকে বিভিন্ন রকম উপসর্গ দেখা দেয়। এই প্রতিফলিত উপসর্গকেই এলার্জী বলে অভিহিত করা হয়। ডাক্তারী ভাষায় বলতে গেলে, যে নির্দিষ্ট কিছু বস্তুর সংস্পর্শে শরীরে বিক্রিয়া শুরু হয়, তাকে বলা হয়-এন্টিজেন বা এলারজেন। আর এই এন্টিজেন বা এলারজেন এর প্রতিরোধে এর বিরুদ্ধে শরীরে যে জিনিষের তৈরী হয়,তাকে বলা হয়-এন্টিবডি। পরবর্তীতে এন্টিজেন আর এন্টিবডির সংঘর্ষে শরীরে যে বিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়, তাকে বলা হয়, এন্টিজেন-এন্টিবডি রিয়েকশন অথ্যাৎ এলার্জী।
এলার্জীর লক্ষণ শরীরে বিভিন্নভাবে প্রকাশ পায়। সাধারণত হঠাৎ করে শরীরে বিভিন্ন ধরনের দানা উঠা শুরু হয় বা শরীরের বিভিন্ন স্থানের ত্বক লাল চাকা চাকা হয়ে ফুলে যায় এবং সেই সাথে প্রচন্ড চুলকোনী থাকতে পারে। অনেক সময় সারা শরীরও ফুলে যায় এবং শ্বাসকষ্ট, বমি, মাথা ব্যথা, পেটে ব্যথা, অস্থিসন্ধি ব্যথা, পাতলা পায়খানা ইত্যাদি হয়। এমনকি হঠাৎ কোন তীব্র এলার্জীক রিয়েকশন হয়ে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। এলার্জীর কারণে যে দানা ও চুলকোনী হয় তা আবার হঠাৎ করে ঔষধ ছাড়াও মিলে যেতে পারে।
তবে এরকম চলতে থাকলে প্রাথমিক অবস্থাতেই সতর্ক হয়ে চিকিৎসক এর পরামর্শ নেওয়া উচিৎ। অনেকেরই ধারণা, এলার্জির কারণ শুধু ইলিশ মাছ, চিংড়ি মাছ, বোয়াল মাছ এবং গরুর মাংস। ফলে এলার্জি হলেই, সবসময় দোষ ঐ চার বেচারার উপর চাপিয়ে দেয়া হয়, যেন- "যত দোষ ঐ নন্দ ঘোষ''। আসলে ব্যাপারটি ঠিক নয়, পৃথিবীর সব জিনিসই এলার্জির কারণ হতে পারে। একেক জনের দেহ ও ত্বক একেক ধরনের জিনিষের প্রতি এলার্জীক হয়ে থাকে। যে কোন খাদ্যদ্রব্য, পরিধেয় ও ব্যবহার্য জিনিষপত্র, প্রসাধনী সামগ্রী, মশা-মাছি ও পোকা-মাকড় এর কামড়, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, ধুলা-বালি, আবহাওয়া, সূর্যালোক, এমনকি নির্দিষ্ট কোন ওষুধও কারো কারো শরীরে এলার্জীক হতে পারে।elergy
এছাড়া কৃমি, আঘাত ও দুশ্চিন্তাতেও এলার্জী হতে পারে। যাদের বংশে হাঁপানি, একজিমা বা এলার্জীস আছে তাদের এলার্জীর প্রবণতা তুলনামূলকভাবে অন্যদের চেয়ে অনেক বেশী। উল্লেখযোগ্য যে, হাঁপানি রোগের অন্যতম একটি প্রধান কারণ হচ্ছে এলার্জী।
সঠিক ও উপযুক্ত চিকিৎসার পূর্বশর্তই হচ্ছে- এলার্জীক জিনিষটি অর্থাৎ এলার্জীর কারণটি খুঁেজ বের করা। তাই রোগীকে সবসময় সচেতন থাকতে হবে এবং আন্তরিকভাবে চেষ্টা চালাতে হবে কিসের সঙ্গে তার এলার্জী সম্পর্কিত তা খুঁজে বের করার জন্য। এ বিষয়ে চিকিৎসকের পক্ষে রোগীকে শুধু পরামর্শ দিয়ে গাইড করা সম্ভব। কিন্তু নিশ্চিতভাবে কারণ বলা সম্ভব নয়। রোগীকেই নিজস্বার্থে চেষ্টা করে এটা বের করতে হবে। যার বেলায় যেটা সংশ্লিষ্ট কেবলমাত্র সেটাই তাকে এড়িয়ে চলতে হবে, শুধু শুধু সব খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করা অর্থহীন। অনেকের ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত কারণ খুঁজে বের করা সম্ভব হয় না।
যদি এলার্জী সৃষ্টিকারী জিনিষটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়, তবে সেটা এড়িয়ে চলাই ভাল থাকার সবচেয়ে সহজ উপায়। নচেৎ ঐ নির্দিষ্ট জিনিষের সংস্পর্শে সে যতবার আসবে বা যতদিন সংস্পর্শে থাকবে, তার সমস্যাও ততবার বা ততদিন চলবে। তবে, অনেকের ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে শরীরের সংবেদনশীলতা কমে গিয়ে তা এক দিন স্বাভাবিক অবস্থায় চলে আসতে পারে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, একজনের শরীর যে শুধু মাত্র একটি জিনিষের প্রতিই এলার্জীক থাকবে এমনও কোন কথা নেই, কপাল খারাপ থাকলে একই ব্যক্তির শরীর একাধিক জিনিষের প্রতিও এলার্জীক থাকতে পারে।images (3)
যাদের ক্রনিক এলার্জীর সমস্যা আছে, কিন্তু কোন নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তাদের কিছু বিষয়ে সবসময় সচেতন থাকা উচিত। তাহলে কষ্ট ও তীব্রতা অনেকখানি লাঘব করা সম্ভব। যেমন-
(১) যথাসম্ভব দুশ্চিন্তা মুক্ত জীবন-যাপনের চেষ্টা করতে হবে,
(২) অতিরিক্ত গরম-ঠান্ডা, ধুলা-বালি ও রোদ এড়িয়ে চলতে হবে,
(৩) সিন্থেটিকস এর কাপড় এড়িয়ে সবসময় সূতীর কাপড়-চোপড় ব্যবহার করতে হবে,
(৪) সেন্ট, লোশন, স্প্রে, এরোসল এবং সুগন্ধীযুক্ত সাবান-তেল ও প্রসাধনী সমগ্রী যতদূর সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে,
(৫) বাড়ীতে কুকুর-বিড়াল বা অন্য কোন প্রাণি না পোষাই ভাল,
(৬) মশা-মাছি, পোকা-মাকড়ের কামড় এড়িয়ে চলতে হবে,
(৭) কোন খাদ্যদ্রব্যে বা ওষুধে (বিশেষ করে- সালফার, পেনিসিলিন ও এসপিরিন জাতীয় ওষুধ) সমস্যা হয় কিনা, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে,
(৮) ঘরে কার্পেট ব্যবহার না করলেই ভাল,
(৯) শীতকালে অনেকদিন পর হঠাৎ কোন গরম কাপড় বা লেপ-কম্বল বের করে সরাসরি ব্যবহার না করে তা ধৌত করে এবং একদিন রোদে রেখে ব্যবহার করা ভাল,
(১০) শরীরে কোন ইনফেকশন বা কৃমি হলে যত শীঘ্র সম্ভব তার সুচিকিৎসা করতে হবে,
এলার্জীর অনেক আধুনিক ওষুধপত্র আজকাল আছে, যার মাধ্যমে খুব অল্পসময়েই এলার্জীর কষ্ট ও চুলকোনী থেকে রেহাই পাওয়া যায়। তবে স্থায়ী চিকিৎসা কারণ বের করার উপরই নির্ভরশীল। চিকিৎসক এর উপদেশ ও ওষুধপত্রের মাধ্যমে যে কোন এলার্জীর রোগী সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন অনায়াসেই। মনে রাখতে হবে, এলার্জী হঠাৎ করে যে কোন মানুষের, যে কোন সময়, যে কোন বয়সে, বছরের যে কোন সময় হতে পারে।