25/01/2025
সাপাহার হাসপাতালের কিছু অসহায় প্রাণের জীবন সংগ্রামের গল্প শোনায় আপনাদের।
ঘটনা ১…
সাপাহারের প্রত্যন্ত গ্রামের এক সরল কৃষক।প্যানক্রিয়াটাইটিস রোগ নিয়ে বছর ছয়েক আগে রাজশাহীতে গিয়েছিলো অসহায় অশিক্ষিত এক কৃষক।অপারেশন করে সব ভালোই চলছিলো।সম্পত্তি তিন ছেলের নামে ভাগাভাগি করেছে বছর তিনেক আগে।
জীর্ণ শরীর।কোমড়ের একটু উপরে বুকের দিকে আড়াআড়ি একটা লম্বা ক্ষত চিহ্ন।বয়স ষাটের ধারে।বন্ড সই দিয়ে হাসপাতালের বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছে।এর আগে কয়েকবার বিভিন্ন জায়গায় ডাক্তার দেখানো হয়েছে।ছেলেদের ও অভাবের সংসার।তাই হাসপাতাল ছাড়া অন্য কোথাও চিকিৎসা করানোর সুযোগ নেই।
ফাইন্ডিংস;প্যানক্রিয়াস ক্যান্সার।প্রায় শেষ স্টেজ।তীব্র যন্ত্রণায় বাড়িতে থাকতে পারেনা।অগত্যা হাসপাতাল শেষ আশ্রয়স্থল।হাসপাতাল থেকে জানানো হয়নি তার রোগের কথা।ছয় বছর আগে তার অজান্তেই তার বাম কিডনিটা বের করে নিয়েছে রাজশাহীর সেই ক্লিনিক।সেইটা কয়েকমাস আগে নজিপুরে চিকিৎসা করতে গিয়ে বুঝতে পেরেছে।সরল অসহায় চোখ দুটোতে তীব্র আত্মবিশ্বাস যেন অন্যের অপরাধের শাস্তি স্রষ্টা তাকে দেবেননা।
ঘটনা ২….
বাড়ি সাপাহার উপজেলার অন্য একটি ইউনিয়ন।রোগী প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি হয়েছে হাসপাতালে।সঙ্গী স্ত্রী।
সারারাতের তীব্র শ্বাসকষ্টে যে তাদের ঘুম হয়নি সেইটা তাদের ক্লান্ত চোখগুলোতে বুঝা যাচ্ছে। নয়টা ছেলের কারোরই বাবা-মাকে নিয়ে বিশেষ চিন্তা নেই।
গ্রামের সবুজ মাঠ,প্রাণ জুড়ানো বাতাস তাকে বঞ্চিত করছে অনবরত। মাঝে মাঝেই তার ফুসফুসে পানি জমে।
জমানো টাকা দিয়ে চিকিৎসা করিয়েছে।টাকা ফুরিয়েছে তবে চিকিৎসার প্রয়োজন ফুরায়নি।অগত্যা সরকারি হাসপাতালে বন্ড সই দিয়ে একটা বেডে পড়ে আছে।
রোগীর ব্লাড ক্যান্সার।অনেক আগেই ডাক্তার বলেছে কেমোথেরাপি দিতে।খরচের অঙ্কটা মুখস্ত।তবে নিষ্ঠুর বাস্তব পৃথিবীতে এখনো একটিও কেমোথেরাপি দিতে পারেনি।বাস্তবতা মেনে নিয়েছে।হাসপাতালের নির্দিষ্ট ওষুধে তার চিকিৎসা চলে।ডাক্তার তার ফুসফুসের জল বের করে দিচ্ছে।একটু স্বাভাবিকভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারাটাই তার একমাত্র চাওয়া।
ঘটনা ৩….
মাঘ মাসের রাত।শীতের তীব্রতায় যখন নগরী প্রায় শুন্য,তখনও মার্কেটের গলিতে এক এক মা তার অসহায় শিশুকে নিয়ে বসে আছে।বাড়ি সাপাহার উপজেলার আরো একটি ইউনিয়নে।স্বামী বাচ্চার দায়িত্ব নেবে না।মেয়ের পরিবারও চায়না এই বাচ্চার দায়িত্ব নিতে।নিউমোনিয়া।হাসপাতালের সীমাবদ্ধতা থাকায় বাচ্চাটাকে ভর্তি করানো যায়নি।কিছু মানবিক প্রাণের হস্তক্ষেপে হাসপাতালে বেড মিললো।তবে সার্বক্ষণিক মনিটরিং ও অক্সিজেন সাপ্লাইয়ের মতো ক্যাপাসিটি নেই
এই হাসপাতালে।দু একজনের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় রোগীকে রাজশাহী মেডিকেলে পাঠানো হয়।কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব অনেক আশ্বাস দিলেও আসলে এড়িয়েছে বিভিন্ন অজুহাতে।আই সি ইউ এর খরচসহ চিকিৎসা ব্যয় দৈনিক প্রায় ২৫০০-৩০০০টাকা।কিছু স্থানীয় যুবকদের সাথে নিয়ে বাজারের দোকানে দোকানে সাহায্যের বাক্স নিয়ে ঘুরেছেন দিনের পর দিন।রাজশাহীতে নিয়োজিত কিছু প্রাণ রয়েছে,যারা সাপাহারের মানুষদের জন্য ঈশ্বরের দূতের মতো কাজ করে।সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা বাঁচাতে পারেনি শিশুটিকে।শিশুটিকে দাফন করিয়ে তার মাকে যুব উন্নয়নের ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে কিছু মানুষ।
ঘটনা ৪…
এক মধ্য বয়সী এতিম মহিলা।বাড়ি সাপাহারের কোন এক অজপাড়াগাঁয়ে।জীবনে সুস্থ থাকতে তার ১০/১৫ টাকার দেনার দায় টানতে হয়।শরীরে মাঝে মাঝেই হিমগ্লোবিন ৪/৫ এ নেমে আসে।হাসপাতালে এসে ভর্তি হয়।৩/৪ ব্যাগ রক্ত লাগে।স্থানীয় কিছু মানুষ তাকে রক্তের ব্যবস্থা করে দেয়।তাদের (ব্লাড ডোনার)আসা,যাওয়া,জুস,খাওয়া সব খরচ মহিলাকেই দিতে হয়।একটু সুস্হ হলে কাজ কর্ম করে ধার পরিশোধ করে।আবার ধার করে চলে পরবর্তী চিকিৎসা ব্যয়।
এই এই হিমগ্লোবিন কমে যাওয়ার কারণ বের করতে যে খরচ প্রয়োজন তার সেই সামর্থ্য নেই।বছর দুয়েক ধরে চেষ্টা করছে চিকিৎসার খরচ বের করার।তবে স্রষ্টার অদ্ভুত পরিকল্পনায় ১০/১৫ হাজার টাকার চক্করে সে আটকা পড়েছে।
৫০ বেডের একটা হাসপাতালে ৬০/৭০ জন রোগী থাকে নিয়মিত।রোগীর লোকজন সহ সেই সংখ্যা প্রায় ১০০।অল্প কয়টা ডাক্তার।তারা কেমন করে এটাকে মেইনটেইন করছেন এইটা নিয়ে জানার চেষ্টা কি আমারা করছি?প্রায় অর্ধেক খরচে হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো হচ্ছে সেইটা কি প্রচার করছি?
কি মনে করেন?প্রতিদিন ইন্ডোর-আউটডোর মিলিয়ে কত ঔষুধ বিতরণ করা হয় সেইটা না জেনেই ঔষধ নাই কেন নিয়ে হট্টগোল করলেই রোগীদের উপকার হবে?দুপুরের খাবার মেনুতে কি রাখছে সেইটা দেখলেই আপনারা প্রপার মনিটরিং করছেন?
পরিবার,শুভাকাঙ্খী,নেতা,জনপ্রতনিধি,সবাই যখন হাল ছেড়েছে,তখনো কিছু মানুষ তাদের যন্ত্রণা কমাতে চেষ্টা করে যাচ্ছে অবিরাম।তাদের অনেকের ইকোনোমিক্যাল ও পলিটিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড অনেক স্ট্রং।তবুও সব ছাপিয়ে শুধু মানুষের পরিচয়ে তারা প্রায় এক দশক ধরে অসহায় মানুষদের জন্য কাজ করছে।তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা।এই মানুষগুলোই আমাদের গর্ব।
আমরা যারা দেশ বদল,সুষ্ঠ নির্বাচন,অবকাঠামোর পরিবর্তন, আইন শৃংখলা সর্বোপরি দেশের উন্নতি নিয়ে চিন্তা করছি,আমাদের পরিকল্পনায় আসলে কি কি বিষয় বস্তু আছে?মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের বাদ দিয়ে হতদরিদ্রদের পাশে একটু সহযোগিতার হাত বাড়ালেও অনেক বদলাতো দেশ।অনেক বদলাতাম আমরা।এই যত মানুষ দেশের জন্য নিজেকে উৎসর্গের ভাষণ দেই তারা এই অসহায় মানুষগুলোর জন্য কি করতে চাই?২/১ জনের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় যদি ২/১ টা রোগী ও পরিবার উপকৃত পারে তবে আপনারা এত বড় সংগঠন কেন এইসব মানুষদের জন্য কিচ্ছু করতে পারছেন না ?
আমরা এখনো পড়ে আছি,ভাগাভাগি,মিটিং,মিছিল,ব্যানার,কম্বল বিতরণের ছবি প্রচারে।নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থে রাজনৈতিক আশ্রয় খুঁজতে।শেয়াল-হায়নারা দলবদ্ধভাবেই থাকে।দেশটাকে ভাগাড় বানিয়ে যারা পালিয়েছে;আমরা সেই ভাগাড়ের পরবর্তী কাক নয় কী?
লিখা কৃতজ্ঞতায় Tamal Nath