17/03/2024
হাতুড়ে/কোয়াক/ভূয়া ডেন্টিস্ট বলতে সাধারণত এমন কারও কথা মনে হবে যিনি রাস্তার পাশে ফুটপাতে বসে দাঁতের সকল চিকিৎসা গ্যারান্টি সহকারে করে থাকেন! কিন্তু না, দিনবদলের হাওয়ায় তারা আজ নিজেদের প্রতারণার কৌশল বদলিয়েছে। এখন আর শুধু নিরীহ সহজ-সরল মানুষদের বোকা বানিয়ে দাঁতের পোকা বের করার কথা বলে টাকা হাতিয়ে নেয় না; বরঞ্চ এখন তাদের অভিনব প্রতারণার ফাঁদে পা দিচ্ছেন শিক্ষিত মানুষজনরাও!
এসব ভূয়া ডেন্টিস্টরা যেভাবে ডেন্টাল চেয়ার, আধুনিক যন্ত্রপাতি সমৃদ্ধ সুসজ্জিত দোকান খুলে বসেছে, হঠাৎ করে সন্দেহ করার বিষয় মাথায়ই আসবে না। এদের সাইনবোর্ড,প্রেসক্রিপশন প্যাড আর ভিজিটিং কার্ডে থাকে বাহারি কাল্পনিক ডিগ্রীর সমাহার। আর যেভাবে গায়ে এপ্রোন আর গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলিয়ে পুরোদস্তুর ডাক্তার সেজে বসে থাকে, সচেতন মানুষ জনও বুঝতে না পেরে প্রতারিত হচ্ছেন হরহামেশাই। চোর পালালে যেমন বুদ্ধি বাড়ে, ঠিক তেমনি অপচিকিৎসার স্বীকার হলে তখন খোঁজ নিয়ে জানা যায়- ইনি আসলে ডেন্টিস্টই নন!
বাংলাদেশ মেডিক্যাল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (BM&DC) এক্ট ২০১০ এর ধারা ২২(১,২) অনুযায়ী শুধুমাত্র MBBS এবং BDS ডিগ্রীধারীরা "ডাক্তার" হিসেবে মানুষের চিকিৎসা সেবা দিতে পারবে। তারমধ্যে দাঁত এবং মুখগহ্বরের যেকোনো রোগের চিকিৎসা করতে পারবেন শুধুমাত্র BDS ডিগ্রীধারী ডেন্টাল সার্জন গণ। এক কথায় বলতে গেলে BDS ডিগ্রীধারী ব্যাতীত কেউ দাঁতের চিকিৎসক নন।
MBBS এবং BDS ডিগ্রীধারী ব্যাতীত কেউ নামের পূর্বে ডাক্তার লিখতে পারবেন না,নিজেকে ডাক্তার হিসেবে পরিচয় দিতে পারবেন না, ডাক্তার সেজে কোনো চিকিৎসা প্রদান করতে পারবেন না; এসব আইনত দণ্ডনীয়। তাই এসব ভূয়া স্বঘোষিত ডেন্টিস্টরা নামের পূর্বে "ডেন্টিস্ট", " দন্ত প্রযুক্তিবিদ", "ডেন্টাল টেকনোলজিস্ট", " দন্ত বিশেষজ্ঞ" - ইত্যাদি উপাধি জুড়ে দেন। শুধু তাই নয়, BM&DC যেমন চিকিৎসকদের রেজিষ্ট্রেশন নম্বর দেয়; সেটার অনুকরণে অনেকে অস্তিত্বহীন লাইসেন্স নম্বরও ব্যাবহার করেন! যারা বিএসসি ইন ডেন্টাল টেকনলোজি কিংবা ডিপ্লোমা ইন ডেন্টাল টেকনলোজি নিয়ে পড়াশোনা করেন, তারা চতুরতার সাথে নিজেদের ডিগ্রী থেকে "ডেন্টাল টেকনলোজি" অংশ টুকু মুছে ফেলে "ডেন্টিস্ট্রি" লাগিয়ে দেন। তাদের কার্যপরিধি ডেন্টাল ল্যাবে ক্রাউন-ব্রীজ-ডেনচার তৈরী, ডেন্টাল চেয়ার এবং অন্যান্য ইন্সট্রুমেন্টস সেটআপ-রক্ষণাবেক্ষণ, ডেন্টাল সার্জনের সহযোগী হিসেবে সীমাবদ্ধ থাকলেও তারা তাদের কাজ বাদ দিয়ে ডেন্টিস্ট সেজে রোগী দেখা শুরু করে!!
যে কেউ উদ্যোক্তা হিসেবে ডেন্টাল চেম্বার দিতে পারে, তবে চিকিৎসা করার জন্যে অবশ্যই বিডিএস ডিগ্রীধারী ডেন্টাল সার্জন প্রয়োজন। এতদিন যার কাছে চিকিৎসা করেছেন কিংবা নতুন কোনো ডেন্টাল চেম্বারে গেলে ডেন্টিস্ট বিডিএস ডিগ্রীধারী কিনা, সেটা অবশ্যই যাচাই করে নিবেন। চেম্বারের সাইনবোর্ডে বিডিএস ডিগ্রীধারী ডেন্টিস্টের কথা উল্লেখ থাকলেও যাচাই করতে হবে যে আসলেই উনি চিকিৎসা দিচ্ছেন, নাকি উনার পরিচয় ব্যাবহার করে কোনো হাতুড়ে ডেন্টিস্ট প্রতারণা করছে!
https://verify.bmdc.org.bd/ ওয়েবসাইটে গিয়ে বিএমডিসি রেজিষ্ট্রেশন নম্বর দিলে ডেন্টাল সার্জনের নাম, ছবি, পিতার নাম, মাতার নাম চলে আসবে।
ভূয়া ডেন্টিস্টদের নিকট "কম টাকায় চিকিৎসা" করাতে যাবেন না, তাহলে যে ক্ষতি হবে পরবর্তীতে অনেক বেশী টাকা খরচ করেও হয়তো তার সমাধান করাতে পারবেন না। ভূয়া হাতুড়ে ডেন্টিস্ট দ্বারা যেভাবে প্রতারিত হতে পারেন-
🦷 নিম্নমানের পুডিং/ফিলিং/ঢালাই করে দিবে; কিন্তু সঠিকভাবে রেস্টোরেশন করতে পারবে না। ফলশ্রুতিতে অতিদ্রুত দাঁতে পাল্পাইটিস হতে পারে।
🦷 রুট ক্যানেল ট্রিটমেন্ট করতে গেলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এরা ক্যানেলই খুঁজে পায় না। যে দাঁত সঠিকভাবে চিকিৎসা করে সংরক্ষণ করা সম্ভব ছিলো, সে দাঁতে ড্রিল করে কৃত্রিম ফুটা করে নষ্ট করে দিতে পারে। আবার ক্যানেল খুঁজে পেলেও সঠিকভাবে সীল করতে পারে না। পরবর্তীতে বিডিএস ডিগ্রীধারী ডেন্টিস্টের নিকট গিয়ে বেশী টাকা খরচ করে পুনরায় রূট ক্যানেল ট্রিটমেন্ট করতে হবে, কিংবা সংরক্ষণের অযোগ্য হলে ফেলে দিতে হতে পারে।
🦷 যে দাঁতে ক্রাউন করার বিন্দুমাত্র প্রয়োজন নেই, আপনাকে উল্টোপাল্টা বুঝিয়ে ক্রাউন-ব্রীজ করতে পারে। বিশেষ করে যেখানে অর্থোডন্টিক চিকিৎসা প্রয়োজন, রেফার না করে ভালো দাঁত কেটেকুটে ক্রাউন পড়িয়ে দেয়! পরবর্তীতে পেশেন্ট যখন ভূল বুঝতে পারে, তখন ভোগান্তির সীমা থাকে না।
🦷 সঠিকভাবে দাঁত তুলতে পারে না; বিশেষ করে আক্কেল দাঁত তুলতে গেলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোগীর বারোটা বাজিয়ে দেয়। কখনও অর্ধেক তুলে বাকি অর্ধেক রেখে দেয়, আবার কখনও নার্ভ ক্ষতিগ্রস্থ করে ফেলে।
তাই সামর্থবান হলে দাঁত ও মুখগহ্বর এর যেকোনো সমস্যায় নিকটস্থ বিডিএস ডিগ্রীধারী ডেন্টিস্টের শরনাপন্ন হউন; আর সামর্থ না থাকলে সরকারি ডেন্টাল কলেজ কিংবা সরকারি মেডিক্যাল কলেজের ডেন্টাল ইউনিটে যেতে পারেন। খরচ কমাতে গিয়ে আপনার মূল্যবান টাকা প্রতারকের হাতে তুলে দিয়ে অপচিকিৎসার স্বীকার হবেন না।
সব সম্ভবের দেশে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়, প্রশাসনকে "ম্যানেজ" করে এরা অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু সবাই সচেতন হলে তখন ঠিকই তারা এই পথ ছেড়ে উপার্জনের জন্য অন্য পথ খুঁজে নিবে। তাই, আসুন সবাই সচেতন হই।
মনে রাখবেন- "বিডিএস নয় তো - ডেন্টিস্ট নয়"