23/07/2025
আরিয়ানের পোড়া শরীর এবং কিছু কথা
…………………………………………
মাইলস্টোন ট্রাজেডির প্রতিকী ছবি এটাই। পরনের বস্ত্রসহ শরীর পুরোটাই পড়ে গেছে। তবুও শিশুটি মা বাবার খুজে দৌড়াচ্ছে। এর ছেয়ে ভয়ানক কোন ছবি হতেই পারে না। এ ছবি দেখার পর পুরো একদিন আমি ঘোরের মধ্যে ছিলাম।। এই ছোট্ট শিশু এত কষ্ট কেমন করে সহ্য করল।
আমার চিকিৎসক জীবনে পোড়া রোগী অনেক দেখেছি। প্রতিটি রোগীর শারীরিক ও মানসিক কষ্ট আমি নানাভাবে উপলব্ধি করেছি। শরীরের এক পারসেন্ট বা দু পারসেন্ট পোড়ে গেলে ও কষ্ট সহ্য করতে পারা দুঃসাধ্য । পুরো জ্বলন্ত শরীর নিয়ে শিশুটির দৌড়ের চিত্রটি চোখের রেটিনা থেকে কখনো মুছে যাবে না।
ত্বকরোগের একজন ছাত্র হিসেবে মাঝে মাঝে মনে হয়, ত্বকের সবচেয়ে বড় শত্রু হলো আগুন। মহান সৃষ্টিকর্তা এত নিপুন দক্ষতার সাথে মানুষের ত্বক তৈরি করেছেন,-- এর গঠন শৈলী অধ্যয়ন করলে অবাক হতে হয়। ত্বকের কোষ কলা কতটা গভীর প্রকৌশলে নির্মিত । প্রতিদিন ত্বকের কোষগুলো মরে ঝরে যায়, আবার পুরো একটা কোষদল প্রতিদিন সমপরিমাণ নতুন কোষ তৈরি করছে, কোন কোন কোষ বাইরে থেকে কোন জীবাণু বা ক্ষতিকর পদার্থ ঢুকার সাথে সাথেই পাকড়াও করছে, কোন কোন কোষ থেকে ত্বকের সুরক্ষার জন্য মেলানিন তৈরি হচ্ছে , কোনটা আবার ত্বকের কোমল স্পর্শ অনুভবের কাজ করছে।। বেশি গরম লাগলে, ঘর্মগ্রন্থী ঘাম নিঃসরণের মাধ্যমে ত্বককে শীতল করে দিচ্ছে, শরীর রুক্ষ হয়ে গেলে, তৈলগ্রন্থি থেকে নিঃসরিত শিবাম ত্বককে মোলায়েম করে দিচ্ছে । কিন্তু ত্বকের সব স্তর পুড়ে যাওয়া মানে বেশিরভাগ কার্যক্রম চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়া। ত্বক তখন ত্বক নয়, যেন শুধুই একটি আবরণ মাত্র।তবে ত্বকের শুধু উপরের অংশ পুড়ে গেলে ত্বক তার গঠনশৈলীকে পুরোপুরি পুনঃনির্মাণ করতে পারে। যাইহোক পোড়া রোগীর কষ্ট, সারা জীবনের কষ্ট। এসব রোগীদের চিকিৎসা সব সময়ই বেশ ব্যয় সাপেক্ষ ও দীর্ঘমেয়াদি।
আরিয়ান নামে ছবির ছেলেটি মরে গিয়ে বেঁচে গেছে। বেঁচে থাকলে এ পোড়া বাংলাদেশে বেঁচে থাকা বেশ কষ্টকর হতো।
অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, আমাদের দেশে এখনো পোড়া রোগীর চিকিৎসার উপযুক্ত ব্যবস্থা নেই। পোস্ট বার্ন কন্ট্রাকচার অর্থাৎ পুড়ে যাওয়ার কয়েক মাস বা বছর পর শরীরের ত্বকে যখন টান ধরে যায়, তখন বেশ কিছু সার্জারি প্রয়োজন হয়। আমার পরিচিত বেশিরভাগ রোগীই দেশের নামি দামি হাসপাতালে সার্জারি করে জীবনের সঞ্চিত সব অর্থ ব্যয় করেও তেমন ভালো ফল পেতে আমি দেখিনি। বিদেশের বিজ্ঞ ও খ্যাতনামা চিকিৎসকরা যদি দেশে চিকিৎসা দিতে আসেন, তাহলে তাদেরকে নিরুৎসাহিত৷ করার কোন কারণ নেই। ওদের কাছ থেকে শেখার অনেক কিছু আছে।
যারা এখন শুয়ে আছেন, তাদের সামনে অপেক্ষা করে আছে অনেক কষ্ট অতি দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা। ইউরোপ আমেরিকার অনেকগুলো বার্ন ইউনিট দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। বার্ন ইউনিটেরর সবচেয়ে বড় প্রায়োরিটি হচ্ছে জীবাণুমুক্ত পরিবেশ। প্রাথমিক অবস্থায় সংক্রমণ প্রতিরোধ ই সবচেয়ে বড় কাজ। পুরোপুরি স্টেরিলাইজড কাপড়চোপড়, মাক্স, ব্যান্ডেজ, ক্যাপ, স্যান্ডেল ছাড়া কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। চিকিৎসকরাও ইউনিটে একইভাবে ঢোকেন। আমি লক্ষ্য করেছি, আমাদের আইসিউগুলোতে স্টেরিলিজেশন মেন্টেইন না করা লোকজনের আনাগোনা অনেক বেশি।এ বিষয়ে সচেতনতা খুবই জরুরী। মনে রাখতে হবে এখন যারা মারা যাবে তাদের বেশিরভাগই সংক্রমনের কারণেই মারা যাবেন। এছাড়াও এখন থেকেই প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার জন্য প্রস্তুতি।
তবে সবচেয়ে যা প্রয়োজন সেটা হল, আগুনে পোড়া প্রতিরোধ করতে হবে। আরিয়ানদের মৃত্যু জন্য দায়ী মূলত আমরা সবাই। যে যুদ্ধ বিমানটি ক্রয় করা হয়েছিল সেটা ছিল ওই কোম্পানির সর্বশেষ বিমান। এরপর এ মডেল তারা তৈরি করেনি। এ ধরনের বিমান কেনার অর্থ হচ্ছে পরবর্তী মেনটেনেন্স সার্ভিস যথাযথভাবে না পাওয়া। ওই কোম্পানি তখন এ বিমান টি না কিনে অন্য মডেল ক্রয় করার পরামর্শ দিয়েছিল। এক হয়ে যদি কোন দুর্নীতি বা টেকনিকের ঘাটতি থেকে থাকে , তবে অবশ্যই এটাকে জবাবদীর আওতায় আনা অবশ্যই উচিত। কুর্মিটোলা রান ওয়ের একদম মাথায় এরকম একটি স্কুল যারা নির্মাণ করেছেন, এবং যারা এ নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছেন তারাও দায়ী। প্রশিক্ষণ বিমান চালানোর জন্য সারা বিশ্বেই নির্জনতম কিছু স্থান পছন্দ করা হয়। বাংলাদেশে চরাঞ্চল অথবা কম জনগোষ্ঠী পূর্ণ এলাকায় এ ধরনের একটি বিমানবন্দর নির্মাণ করা যেত। কিন্তু আমাদের মানসিকতা হচ্ছে আমাদেরকে ঢাকার কেন্দ্রবিন্দুতেই থাকতে হবে। এজন্য পুরো বাহিনীর দায় রয়েছে। এভাবে হিসাব করলে আরো অনেককেই দায়ী করা যাবে। এতগুলো নিষ্পাপ শিশুর এত কষ্টকর মৃত্যুর জন্য যারাই দায়ী, তাদেরকে যেন আল্লাহ হেদায়েত করেন। মনে রাখতে হবে ভুক্তভোগীর পরিবারবর্গ যদি ওদের ক্ষমা না করেন তবে ওদেরকেও দুনিয়া বা আখেরাতে এরচেয়ে ভয়ঙ্কর কষ্ট পেয়ে মরতে হবে।
।।।।।।।।।।।।অধ্যাপক ডা.মোহাম্মদ হাই। ২৩।০৭।২০২৫।।।।।।।।।।।।।।