06/04/2025
বণিক বার্তা
প্রকাশ: রোববার ৬ এপ্রিল ২০২৫
এনআরবি ব্যাংকের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির সঙ্গে প্রবাসীদের সেতুবন্ধ তৈরি করতে চাই :-
এনআরবি ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইকবাল আহমেদ ওবিই |
********************************************************************
প্রবাসী বা অনাবাসী বাংলাদেশীদের (এনআরবি) মধ্যে অনেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সুপ্রতিষ্ঠিত। পেশাজীবী কিংবা ব্যবসায়ী হিসেবে অনেকে বেশ খ্যাতিও অর্জন করেছেন।
ইকবাল আহমেদ ওবিই। চতুর্থ প্রজন্মের এনআরবি ব্যাংক পিএলসির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। প্রায় নয় বছরের বিরতির পর সম্প্রতি তিনি আবারো চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য, বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অবদানের জন্য ব্রিটেনের রানী কর্তৃক সর্বোচ্চ সম্মাননাপ্রাপ্ত এ ব্যবসায়ী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইমামূল হাছান আদনান
আপনার উদ্যোগে ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল এনআরবি ব্যাংক পিএলসি। কী লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য নিয়ে এ নামে ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠা করেছেন?
প্রবাসী বা অনাবাসী বাংলাদেশীদের (এনআরবি) মধ্যে অনেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সুপ্রতিষ্ঠিত। পেশাজীবী কিংবা ব্যবসায়ী হিসেবে অনেকে বেশ খ্যাতিও অর্জন করেছেন। কিন্তু এসব এনআরবিদের দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় প্রজন্মের সঙ্গে বাংলাদেশের তেমন কোনো বন্ধন গড়ে উঠছে না। পিতা-মাতার জন্মস্থান তথা শিকড়ের সঙ্গে এনআরবি ও তাদের প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করার উদ্দেশ্য থেকেই এ ব্যাংকটি করার উদ্যোগ নিই। এজন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী সুপ্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশীদের বিনিয়োগের জন্য আহ্বান জানিয়েছিলাম।
এ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মূল স্বপ্ন ছিল বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা অনাবাসী বাংলাদেশী ও স্থানীয় অর্থনীতির মধ্যে একটি সেতুবন্ধ তৈরি করা। আমরা রেমিট্যান্স ও উৎপাদনশীল খাতে বিদেশী বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে চেয়েছি। প্রবাসীরা যাতে বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে অনলাইনের মাধ্যমে যেকোনো মুদ্রায় (ইউএস ডলার, পাউন্ড, ইউরো) অ্যাকাউন্ট খোলাসহ রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহিত হন, সে ব্যবস্থা করতে চেয়েছি। দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি এ ব্যাংক যেন দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখতে পারে সে লক্ষ্যও আমাদের ছিল। আমরা চেয়েছিলাম এমন একটি গতিশীল ও গ্রাহকবান্ধব প্রতিষ্ঠান করতে যেটি স্বচ্ছতা, উদ্ভাবন ও আস্থার ওপর নির্ভর করে পরিচালিত হবে। আর এ প্রক্রিয়ায় ব্যাংকটির মাধ্যমেই বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা অনাবাসীরা বিনিয়োগ ও অন্যান্য কার্যক্রমের মাধ্যমে তার শেকড়ের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পাবে।
প্রতিষ্ঠার এক যুগ পেরিয়ে সে লক্ষ্য কতটুকু অর্জিত হলো?
সত্যিকার অর্থে যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং প্রচেষ্টা নিয়ে এনআরবি ব্যাংক যাত্রা শুরু করেছিল পরবর্তী সময়ে সেটি সম্পূর্ণরূপে ধরে রাখা যায়নি। গত কয়েক বছরে করপোরেট সুশাসন, পরিচালনা ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বড় রকমের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতি আমাদের একটি সুযোগ দিয়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমরা পুরনো লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে চাই।
ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠার তিন বছরের মাথায় এসে চেয়ারম্যান পদ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন কেন?
এ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবে আমি দায়িত্ব পালন করি। শুরু থেকেই আমরা এনআরবি ব্যাংককে আন্তর্জাতিক মানের একটি ব্যাংক হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলাম। এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কেনাকাটা ও জনবলও নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। আমরা চেয়েছিলাম পরিচালনা পর্ষদ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হোক। এ প্রত্যাশা থেকেই ২০১৬ সালে নতুন নেতৃত্ব তৈরির লক্ষ্যে আমি দায়িত্ব ছেড়ে দিই। তাছাড়া অন্যান্য খাতের বিভিন্ন দিকেও আমার বাড়তি মনোযোগ দেয়ার প্রয়োজন ছিল। সে সময় আমার বিশ্বাস জন্মেছিল যে একটি শক্তিশালী কাঠামোর মাধ্যমে পরিচালিত হতে ব্যাংকটি যথেষ্ট পরিপক্ব হয়েছে। তবে ব্যাংকটির দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য অর্জনের প্রতি আমার প্রতিশ্রুতি সবসময়ই ছিল। দুঃখজনক সত্য হলো চেয়ারম্যান পদ ছাড়ার পর দেখলাম ব্যাংকটিকে পারিবারিক প্রতিষ্ঠান বানানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। গত এক দশকে ব্যাংক খাতে যে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে, তার কালো ছায়া এ ব্যাংকের ওপরও পড়েছে। এক ব্যক্তিই নয় বছর ধরে চেয়ারম্যানের পদ দখল করে রেখেছিলেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপে ৯ বছর পর আবারো আপনি ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পদে ফিরেছেন। এ বিষয়ে আপনার অভিব্যক্তি কী?
আমার প্রতি যে আস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক রেখেছে তাতে আমি সম্মানিত ও কৃতজ্ঞ। এত বছর পর ফেরাকে একটি সুযোগ হিসেবে নিতে চাইছি। আমি বিশ্বাস করি, এটি গ্রাহকসেবার একটি সুযোগ। সুশাসনকে গুরুত্ব দিয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে সঠিক পদক্ষেপের মাধ্যমে ব্যাংকটি পরিচালনা করলে সেবার গুণগত পরিবর্তন হবে এবং আমানতকারীদের আস্থাও ফিরবে। পাশাপাশি আমি এনআরবি ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাকালীন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ফিরিয়ে আনতে চাই। প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ নিশ্চিত করে ব্যাংকের জন্য একটি অত্যন্ত টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনের বিষয়েও আমি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
চতুর্থ প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর মধ্যে এনআরবি ব্যাংক বেশ পিছিয়ে পড়েছে। কী কারণে এমনটি হলো?
পিছিয়ে পড়ার অনেক কারণই রয়েছে। নেতৃত্বের ছন্দপতন একটা বড় কারণ। তাছাড়া কৌশলগত ধারাবাহিকতার অভাব, দুর্বল ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং আমাদের মূল গ্রাহক ভিত্তি এবং পরিষেবা কাঠামোর বিচ্যুতি কারণ হিসেবে কাজ করেছে। পাশাপাশি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের অভ্যন্তরীণ শাসন ব্যবস্থায় অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ, অপারেশনাল দক্ষতায় ব্যাপক ঘাটতি—এ বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট সবার বিশ্বাসের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। আমরা এখন জরুরিভাবে এগুলো কাটিয়ে উঠতে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে দ্রুততার সঙ্গে কাজ করছি।
ব্যাংকটির উন্নয়নে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
আমাদের ভবিষ্যৎ রোডম্যাপ ব্যাপক ও বিস্তৃত। এর মধ্যে রয়েছে করপোরেট গভর্ন্যান্সকে শক্তিশালী করা, ডিজিটাল অবকাঠামোর আধুনিকীকরণ, গ্রাহক পরিষেবার উন্নতি এবং বিশ্বব্যাপী প্রবাসী বাংলাদেশীদের পুনরায় সম্পৃক্ত করা। একই সঙ্গে ব্যবসা প্রসারিত করতে আমরা ব্যাংকিং সেবাকেও বিস্তৃত করার পরিকল্পনা নিয়েছি। এর মধ্যে এসএমই খাতে অর্থায়ন, গ্রিন ব্যাংকিং ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিং নিশ্চিত করতে চাই। কৃষকদের উপযোগী কৃষি ঋণ ও সঞ্চয় পরিকল্পনা, নারীদের জন্য স্বল্প সুদে ঋণসহায়তা, স্বচ্ছতার সঙ্গে ইসলামিক ব্যাংকিং কার্যক্রম সম্প্রসারণের জন্য শরিয়াহসম্মত পরিষেবা, আকর্ষণীয় সঞ্চয় অ্যাকাউন্টসহ যুব ব্যাংকিং, শিক্ষা ঋণ এবং ইন্টার্নশিপের ওপরও জোর দিচ্ছি। এছাড়া নিত্যনতুন উদ্ভাবন, প্রতিভা বিকাশ এবং প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার বিষয়টিও আমাদের নতুন রূপান্তরের এজেন্ডায় থাকবে।
গ্রাহক, বিনিয়োগকারী, শেয়ারহোল্ডার ও ব্যাংকের কর্মকর্তাদের আস্থা ফেরাতে আপনি কী কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন?
বিগত কয়েক বছরে ব্যাংক খাতে যেভাবে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে তাতে সবার আস্থা ফেরাতে প্রথমেই আমরা স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও কর্মদক্ষতার ওপর গুরুত্ব দেব। এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানের ভেতরকার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে আমরা কাজ শুরু করেছি। তাছাড়া অডিট কার্যক্রম শুরু করা, কমপ্লায়েন্স ফ্রেমওয়ার্কগুলোকে পুনর্গঠন এবং স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছি। পাশাপাশি কর্মীদের প্রশিক্ষণ ও অনুপ্রাণিত করার প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। গ্রাহকসেবার চার্টার সংশোধন করা এবং ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাকালীন মূল্যবোধের সঙ্গে আমাদের করপোরেট সংস্কৃতিকে পুনরায় সংযোগ ঘটানোর মতো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ধারাবাহিকভাবে উদাহরণ তৈরি করে নেতৃত্ব দেয়ার মাধ্যমে দৃশ্যমান পরিবর্তন আমরা ঘটাতে চাই।
ব্যাংকটিতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও সার্বিক উন্নয়নে আপনার সামনে কী কী চ্যালেঞ্জ আছে বলে মনে করেন?
পরিবর্তনকে স্বাগত না জানানোর মানসিকতা বদল করা এবং মূল্যবোধ ফিরিয়ে আনাতে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতির পরিবর্তন করা এবং কমপ্লায়েন্স প্রতিষ্ঠা করা হতে পারে প্রধান চ্যালেঞ্জ। ঐতিহ্যগত বিষয়টিও এখানে দ্রুত ফয়সালা করতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং আমাদের সবার পক্ষের সদিচ্ছা আমাকে এ সাহস দিচ্ছে যে আমরা এসব চ্যালেঞ্জ ও প্রতিবন্ধকতা জয় করব। আর এর মাধ্যমেই এনআরবি ব্যাংক একটি টেকসই ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে যাবে।