03/11/2025
আমি দরজায় পা রাখতেই স্ত্রী চিৎকার করে উঠলো,
— “কোথায় ছিলে আজ সারাদিন? অফিসেও খোঁজ নিয়েছি, ওরা বলেছে তুমি আজ যাওনি!”
আমি একটু ইতস্তত করে বললাম
— “মানে… আমি আসলে…”
স্ত্রী আমার কথা শেষ করতে না দিয়েই চিৎকার করে উঠল,
— “কথা ঘুরিও না! আমি সব বুঝি! আর এই ব্যাগটা? পুরোনো কাপড়ভর্তি ব্যাগ আবার কোথা থেকে আনলে?”
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে তারপর শান্ত কণ্ঠে বললাম
— “আমি গ্রামে গিয়েছিলাম… মা’কে আনতে।”
স্ত্রীর মুখের রঙ মুহূর্তেই পাল্টে গেল। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল আমার দিকে, তারপর বিস্ময় আর বিরক্তির মিশ্র সুরে বলল,
— “কি বললে? তোমার মা? তুমি ওনাকে এখানে নিয়ে এসেছ?”
তার চোখে তখন যেন আগুন জ্বলছে।
— “তোমার ভাইয়ের বাড়িতে তো ছিলেন, ওখানেই থাকতে পারতেন! এখানে আবার কেন? এই ছোট ফ্ল্যাটে, যেখানে জায়গা হয় না বাচ্চার পড়ার বই রাখার!”
আমি আস্তে বললাম
— “ওখানে রাখা আর সম্ভব নয়।”
আমার স্ত্রী রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলে উঠল,
— “এখানে কি স্বর্গরাজ্য নাকি? সাত হাজার টাকায় সংসার চালাই, বাচ্চার স্কুল, বাজার, বিল—সব কিছুর চাপ আমার উপর! এখন আবার এক জন বৃদ্ধা?”
স্ত্রীর কথার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের কোণে বসা সাদা শাড়ি পরা আমার বৃদ্ধা মা" কাঁপা হাতে মুখ ঢেকে কাঁদছিলেন।
তার চোখে জল, মুখে লজ্জা ও অসহায়তার ছাপ।
আমি নিচু গলায় বললাম
— “ওনাকে আমার ভাই আর ভাবি বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। তাই নিজে গিয়ে এনেছি।”
স্ত্রী তখনও কিছুটা রাগে ফুঁসছে, কিন্তু হঠাৎই বৃদ্ধ মায়ের মুখটা দেখতে গিয়ে থমকে গেল।
চোখ বড় হয়ে গেল, ঠোঁট কেঁপে উঠল—
— “মা… তুমি?”
বৃদ্ধা মুখ তুলে তাকালেন। চোখে ক্লান্তি, মুখে বেদনা। ধীরে বললেন,
— “হ্যাঁ মা, তোর ভাই আর ভাইয়ের বৌ বলেছে আমি নাকি বোঝা হয়ে গেছি। কোথায় যাব বল?”
স্ত্রীর মুখে আর কথা নেই। হাত কাঁপছে, চোখে জল।
সে আমার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,
— “তুমি আগে বললে না কেন? মা তো মা, তোমার হোক বা আমার—মা তো একজনই!”
ঘরের বাতাস যেন এক মুহূর্তে থেমে গেল।
বৃদ্ধা "মা" ধীরে ধীরে বললেন,
— “না মা, আমি থাকব না এখানে। আমাকে বৃদ্ধাশ্রমেই রেখে আসো।”
সবাই একসাথে চমকে উঠলাম, আমার স্ত্রী অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে বলল,
— “মা! তুমি এমন কথা বলছ কেন?”
বৃদ্ধা কেঁপে কেঁপে বললেন,
— “যে ঘরে এক মা ঠাঁই পায় না, সেখানে অন্য মা’য়েরও থাকা উচিত নয়।
আমি জানি, আমি যেমন একজন সন্তান জন্ম দিয়েছি, তেমনি একটা কন্যাও জন্ম দিয়েছি—যে এখন নিজের মায়ের জায়গা বোঝে না। তাই আমার থাকার জায়গা বৃদ্ধাশ্রমেই মানায়।”
তার কণ্ঠে ছিল না কোনো রাগ, শুধু গভীর শান্তি আর তীব্র বেদনা।
তিনি আরও বললেন,
— “কিন্তু একটাই কথা মনে রেখো মা, সময় বড় কঠিন বিচারক।
আজ যেভাবে আমি বোঝা হয়েছি, একদিন হয়তো তুমিও কারও চোখে বোঝা হয়ে যাবে। তখন বুঝবে, এক মায়ের হৃদয় কতটা বড় হতে হয় সন্তানকে ক্ষমা করতে।”
স্ত্রীর চোখ থেকে অঝোরে জল পড়তে লাগল।
সে মাটিতে বসে পড়ল, বৃদ্ধার পায়ের কাছে মাথা রাখল, কাঁদতে কাঁদতে বলল,
— “মা, আমায় ক্ষমা করো। আমি বুঝতে পারিনি—একটা মা শুধু সন্তান জন্ম দেয় না, সে ঘরটাকেও বাঁচিয়ে রাখে।”
বৃদ্ধা তার মাথায় হাত রাখলেন, কাঁপা গলায় বললেন,
— “ক্ষমা করার কিছু নেই মা। সময়ই সব শেখায়।
মা তো শেষ পর্যন্ত মাই থাকে—তোর সুখই চাই।”
ঘরে তখন শুধু কান্নার শব্দ।
বাইরে বৃষ্টি পড়ছে টুপটাপ, যেন আকাশও কাঁদছে এক ভুলে যাওয়া মায়ের জন্য।
আসলে
যে ঘরে মা’য়ের জন্য জায়গা হয় না, সেই ঘর কখনো শান্তি পায় না।
মা শুধু মানুষ নন—তিনি আশীর্বাদ, তিনি ঘরের প্রাণ।
❣️❣️