08/05/2020
হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার ইতিহাস:
হোমিওপ্যাথি একটি সার্বজনীন ও বিশ্বজনীন চিকিৎসাবিজ্ঞান। জার্মান চিকিৎসক ডা. স্যামুয়েল হ্যানিম্যান ১৭৯০ খ্রিষ্টাব্দে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা-পদ্ধতি আবিষ্কার করেন।
তিনি প্রথমে ছিলেন একজন বিখ্যাত এলোপ্যাথিক চিকিৎসক। ১৭৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ১০ এপ্রিল জার্মানির মিশেনে স্যাকসনি নগরে হ্যানিম্যানের জন্ম। তার পুরো নাম ক্রিস্টিয়ান ফ্রেড্রিক স্যামুয়েল হ্যানিম্যান। তিনি ৮৮ বছর বয়সে ১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ২ জুলাই প্যারিসে মৃত্যুবরণ করেন।
হ্যানিম্যান ২২ বছর বয়সে ১১টি ভাষায় পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। তিনি জার্মান, গ্রীক, ল্যাটিন, ইংরেজি, ইটালিয়ান, হিব্রু, সিরিয়াক, আরবী, স্প্যানিশ, ফরাসী ও চ্যালডেইক ভাষায় লিখতে, পড়তে ও অনুবাদ করতে পারতেন।
হ্যানিম্যানের ১১৬টি বৃহৎ গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বড় গ্রন্থ হলো- ফ্রাগমেন্ট দ্য ভিরিবাম (১৮০৫), অর্গানন অব মেডিসিন (১৮১০), মেটিরিয়া মেডিকা পিউরা (১৮১১), ক্রণিক ডিজিজেস (১৮১৮)।
হ্যানিম্যান দীর্ঘসময় ধরে চিকিৎসাবিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়াদি নিয়ে গবেষণা এবং ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখান যে, প্রচলিত এলোপ্যাথি চিকিৎসায় রোগের কেবলমাত্র সাময়িক উপশম হয় এবং এই চিকিৎসা প্রথার সাফল্যের সাথে কিছু বিষময় ফল বা প্রতিক্রিয়া অনতিবিলম্বে দেখা দেয়। আজ যে ওষুধ অমোঘ বলে ঘোষিত হলো দুদিন যেতে না যেতেই তা মানুষের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকারক বলে পরিত্যক্ত হয়।
এক রোগ চাপা পড়ে অন্য রোগ সৃষ্টি হয় এবং এ ধরনের চিকিৎসার কুফলে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। ফলে অনেক বিবেকবান খ্যাতিমান চিকিৎসক তৎকালীন চিকিৎসা-প্রথার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠে।
তিনি ক্রমান্বয়ে প্রচলিত চিকিৎসা-পদ্ধতি পরিত্যাগ করে রোগার্ত মানুষকে বিনা কষ্টে স্বল্প সময়ে স্থায়ীভাবে রোগ নির্মূল তথা প্রাকৃতিক আরোগ্য সাধন পদ্ধতি অনুসন্ধানে নিজেকে উৎসর্গ করেন। দীর্ঘদিন গবেষণার পর অবশেষে ১৭৯৬ সালে হ্যানিম্যান উদাত্তকণ্ঠে ঘোষণা করলেন- ‘রোগারোগ্যের শাশ্বত পথের সন্ধান আমি পেয়েছি। সেই পথ প্রকৃতির সঙ্গে সমঝোতার পথ।
প্রকৃতির সঙ্গে বিরুদ্ধাচারণ করে নির্মল আরোগ্য বিধান সম্ভব নয়। আদর্শ আরোগ্য নিমিত্ত প্রকৃতি নির্দিষ্ট একটি মাত্র পথ আছে তা হলো Similia Similibus Curentur অর্থাৎ যে ভেষজ সুস্থ দেহে যে ধরনের রোগ সৃষ্টি করতে সক্ষম সেই ধরনের রোগ সেই ভেষজ দ্বারাই আরোগ্য লাভ সম্ভব।’
হ্যানিম্যান এর নতুন চিকিৎসা-পদ্ধতির নাম দেন Homoeopathy অর্থাৎ সদৃশ্য আরোগ্য বিধান পদ্ধতি।
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের মূলনীতিসমূহ : (১) সদৃশ নিয়মে চিকিৎসা-সিমিলিয়া সিমিলিবাস কিউরেন্টার (সদৃশ দ্বারা সদৃশ আরোগ্য)। (২) সুস্থ্য মানবদেহের ওপর পরীক্ষিত ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা করা। (৩) শক্তিকৃত (Potentized) ওষুধের সাহায্যে চিকিৎসা করা। (৪) রোগীর বৈশিষ্ট্যপূর্ণ লক্ষণ সমষ্টির সদৃশ লক্ষণে ওষুধ প্রয়োগ করা। (৫) প্রতিবারে একটি মাত্র ওষুধ প্রয়োগ করা। (৬) প্রতিবারে ওষুধ পরিবর্তিত মাত্রায় প্রয়োগ করা। (৭) ওষুধ সূক্ষ্ম বা ক্ষুদ্রতম মাত্রায় প্রয়োগ করা। (৮) হোমিওপ্যাথিতে রোগের নয়, রোগীকে চিকিৎসা করা হয়- রোগীকে আঙ্গিক বা আংশিকভাবে নয়, সামগ্রিকভাবে চিকিৎসা করা হয়। (৯) Plants, Animals, Minerals, Nosodes, Sarcodes and Imponderabalis source থেকে সংগ্রহীত এবং পরীক্ষিত ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়।
বিশ্বব্যাপী হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের প্রসার ও অগ্রগতি :
হ্যানিম্যানের জীবদ্দশায় বিশ্বব্যাপী এর প্রচার ও প্রসার হতে থাকে। প্রথমে জার্মানী, পরে ফ্রান্স, বৃটেন, আমেরিকা, রাশিয়া; এমনকি ভারত বর্ষ পর্যন্ত এর বিস্তার ঘটে। বর্তমানে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা-ব্যবস্থা আপন মহিমায় প্রজ্বলিত। উনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপের অনেক রাজা রানী, জার ও সম্রাট হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার কার্যকারিতা প্রত্যক্ষ করে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকদের রাজ চিকিৎসক হিসেবে নিয়োগ করেন। ফলে বৃটিশ রাজ পরিবারে হোমিওপ্যাথির জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। ১৯২৫ সালে বৃটেনের রাজা পঞ্চম জর্জ প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রীয়ভাবে একজন হোমিওপ্যাথিক রাজ চিকিৎসক নিয়োগ করেন। রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথও ব্যক্তিগত চিকিৎসক হিসেবে একজন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসককে নিয়োগ দেন। এছাড়া তিনি বৃটেনের প্রধান হোমিওপ্যাথিক হাসপাতাল রয়্যাল লন্ডন হোমিওপ্যাথিক হাসপাতালের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে নিজেকে নিয়োজিত করেন। বর্তমানে বৃটেনে মোট ছয়টি সরকারি হোমিওপ্যাথিক হাসপাতাল চালু রয়েছে। ১৮৩৫ সাল হতে আমেরিকায় হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে আমেরিকায় বিশ্বের নাম করা হোমিওপ্যাথিক ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বোরিক এন্ড ট্যাফেল কোম্পানি বিশ্বে শীর্ষস্থানে অবস্থান করছে। ১৮৩৭ সালে পূর্ণাঙ্গভাবে ভারতে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে ভারতে এ চিকিৎসা-পদ্ধতি রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে হোমিওপ্যাথির ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা চলছে। গ্রীসে ১৯৬৭ সাল থেকে হোমিওপ্যাথিক শিক্ষা ও চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু হয়।
বর্তমানে বিশ্বে সাড়া জাগানো হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক ডা. জর্জ ভিথোলকাসের বাড়ি গ্রীসে। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে অনন্য অবদান রাখার জন্য ১৯৯৬ সালে সুইডিস পার্লামেন্ট তাকে Right Livelyhood Award (Alternative Noble Prize) এ ভূষিত করে। তার মতে, রোগের প্রথম অবস্থায় (৭০-৮০%) রোগ হোমিওপ্যাথিতে নিরাময় করা সম্ভব।
আমেরিকান চিকিৎসাবিজ্ঞানী ড. কন্সটেন্টাইন হেরিং, ইংল্যান্ডের ড. কুইন, আমেরিকার ডা. এলগোস প্রমুখ পরবর্তীতে ডা. ডাজেন, ডা. এডি লিপি, ডা. জেটিকেন্ট, ডা. ক্লার্ক, ডা. বেকিং, ডা. জেএন কাঞ্জিলাল, ডা. কেএন মাথুর প্রমুখ প্রখ্যাত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎকদের মধ্যে অন্যতম।
হোমিওপ্যাথিকে অগণিত বিজ্ঞানী, দার্শনিক, চিকিৎসাবিদ, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী ও গবেষকগণ স্বীকৃতি দিয়েছেন। বিশেষ করে ইংল্যান্ডের ডক্টর ইউলিয়াম বয়েড ইমানুমিটার যন্ত্রে পরীক্ষা করে দেখেন যে হোমিওপ্যাথিক ওষুধ থেকে (Magnatic ray) বা বিদ্যুৎচুম্বক রশ্মি বিচ্ছুরিত হয়। দার্শনিক জর্জ বার্নাডশ তার (Doctorin) নাটকের ভূমিকায় বলেন, হোমিওপ্যাথি ওষুধ বর্ণিতভাবে কাজ করে এটা কেউ অস্বীকার করতে পারে না। বালিং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং বিশ্বের অন্যতম সার্জন বায়োলজির গবেষক হোমিওপ্যাথিক ওষুধ নিজের ও সহকারীর শরীরে পরীক্ষা এবং রোগীর ওপর প্রয়োগ করে লিখেছেন, ‘এক সময় আমার অভিযোগ ছিল হোমিওপ্যাথি বিজ্ঞানবর্জিত ও ফাঁকিবাজি। আসলে হ্যানিম্যান আমার থেকে এক শতাব্দী এগিয়ে থাকায় হোমিওপ্যাথি বুঝতে আমার সময় লেগেছে।
ফ্রান্সের প্রফেসর জ্যাকুই বেনভেনেস্তের নেতৃত্বে তিনটি উন্নত দেশের ১৪ জন বিজ্ঞানীর একটি প্রতিনিধি দল দীর্ঘ ৩ বছর গবেষণা চালিয়ে রিপোর্ট দেন, ‘হোমিওপ্যাথি ওষুধের কার্যকারিতা নিঃসন্দেহ এবং শক্তিকরণ পদ্ধতি বিজ্ঞানভিত্তিক।’
ডাঃ ওয়াই এ আরিফ
মেডিকেল অফিসার
সরকারি হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
ঢাকা।
চেম্বারঃ হ্যানিম্যান হোমিও ক্লিনিক
(সন্ধানী লাইফ ইন্সুইরেন্সের বিপরীতে)
মাদ্রাসা গলি, ৬৫ রসুল ভিউ,
বাংলামোটর, ঢাকা- ১০০০।
মোবাঃ 01912933964