01/11/2025
সন্তান হারা এক মায়ের আর্তনাদ
- সামসুন নাহার প্রিয়া
০১.১১.২০২৫
সকাল ৯.৪৫টা।
প্রিয় জোহা,
আমার প্রিয় একেএম সলিহান সাকিন সিদ্দিকী জোহা,
কিইইইইইইইইইইইইইইইই বিশাল নাম!
আর কি এইটুকুন একটা পাখি!!
কেমন আছো তুমি?
তোমার আম্মু ফাইটব্যাকের প্রগ্রেসে গতোকাল একটু
বেশিই লোড নিয়ে ফেলসিলো।
খিঁচুনি উঠে গেছে। বমি করে দিছে। বেহুঁশ হয়ে গেছে।
এরপর ফাইনালি, দশদিন পর, তোমার দাদাবাড়ি থেকে তোমার আম্মুকে এক গ্লাস বীটরুটের জুস দেয়া হইসে। আমি জানি তুমি ওই ফাইটব্যাকের সময়টাতে অনেক কষ্ট পাইসো। আমিও পাইসি।
আমি তো খুশিই হয়ে গেছিলাম বোধয় ফাইনালি তোমার সাথে আমার দেখা হয়েই যাচ্ছে!
কিন্তু স্যাড!
বেকার খাটনি!
ঘুমটা সেই ঠিক ঠিক ভেঙ্গেই গেলো।
এই দুক্ষের পৃথিবীতে আরো একটা সকাল দেখতে হলো যেই সকালে আমার কোলে আমার বাবুনপাখি জোহা নাই।
জোহা পাখি, আমি এই দশদিন সবাইকে একটা কথাই জিজ্ঞেস করসি।
"আল্লাহ জোহাকে আমার কোলে একবার দিয়ে আল্লাহর কাছে নিয়ে গেলো। আমাকে একবার আল্লাহর কাছে নিয়ে গিয়ে আবার এই বিচ্ছিরি দুনিয়াতে ফেরত দিয়ে গেলো।"
কেন??
কেন আল্লাহ আমাকেও নিলো না?
কেন রেশমা আপা আর দশটা মিনিট লেট করে ওটিতে ঢুকলো না?
পেশেন্ট মরে যাবে এই ভয়ে সিএমসি পাঠিয়ে দিতে গিয়েও কেন পার্কভিউকে রেশমা আপা কল দিয়ে বললো "ওকে রাখো, ও আমার সবচেয়ে ক্রিটিক্যাল পেশেন্ট। ওর বাচ্চা আমার কাছে সবচেয়ে ভ্যালুয়েবল কেইস।"????
কেন আমিই ওয়ান ইন মিলিয়ন কেইস হলাম?
কেন কাহিনি আমার সাথেই হইলো??
আমার ছেলে আমার কোলে নাই কেন??
জোহাবাবুন আমার কাছে নাই কেন??
কেন??
কেন???
কেন? কেন? কেন? কেন? কেন? কেন? কেন? কেন? কেন? কেন? কেন? কেন? কেন? কেন? কেন? কেন? কেন? কেন? কেন? কেন? কেন? কেন? কেন? কেন? কেন? কেন? কেন? কেন?
জানো পাখি,
আমি না ফাইনালি এই প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছি আলহামদুলিল্লাহ। কারণ আমি সবর করতাম। ধৈর্য ধরতাম। ধৈর্য ধরতে ধরতে তোমার আম্মুর জরায়ু শীতকালের টাটকা শিমের মতো মাঝখানে দুইভাগ হয়ে তুমি পুরো স্যাক সহ ইনট্যাক্ট বের হয়ে এসেছো।
তোমার এক্সিস্ট্যান্সের মধ্যে দিয়ে আল্লাহ আমাকে মেসেজ দিয়েছেন, "প্রিয়াবাবুন তুমি ইনফারটাইল না। কখনোই ছিলা না। তুমি একটা সুস্থ বাবুন জন্ম দিতে সক্ষম। দিয়েছোও। কিন্তু এটুকুই। এবার ওকে আমার কাছে দিয়ে দাও পাখি। এই দুনিয়াতে জোহার সাথে তোমার ক্রসওভার এতোটুকুই ছিলো। তোমার জন্যে আমার অনেক প্ল্যান আছে। তুমি সেই প্ল্যানের মেইন ক্যারেক্টার। তোমাকে অনেক কিছু করতে হবে। সব সাইকেল ভাঙতে হবে। তোমাকে একটা নাটকের স্ক্রিপ্ট দিচ্ছি। এই নাটকের নাম " ছোটো আম্মু এবং তার আন্ডা বাচ্চা"। এই নাটকের মেইন ক্যারেক্টার তুমি। চাইলে বাঁশখালীর উঙ্গা বেগম, সাতকানিয়ার চুঙ্গা বেগম, তোমার শ্বাশুড়ি নাসিমা অথবা তোমার মা ফাতেমা যেকোনো কাউকেই সিলেক্ট করতাম। কিন্তু তোমাকে করলাম প্রিয়া পাখি। কারণ, তুমি One in a million.
তোমাকে এই নাটকটার শেষ পর্যন্ত প্লে করে যেতে হবে। কষ্ট হবে। আমি জানি। অনেক কষ্ট হবে। কিন্তু থেমে থাকা যাবেনা। কষ্ট হলেও হাসতে হবে। বেশি বেশি ফ্রুটস খেতে হবে। তোমার কামব্যাক হবেই। আমি তোমার কামব্যাক হওয়াবোই। তোমার সবচেয়ে বড়, সবার প্রথম ফ্যানবয় তোমার ছেলে। ও উপরে বসে বসে তোমার এক্টিং দেখবে। তোমার সাথে হাসবে, তোমার সাথে কাঁদবে। তুমি যেদিন বেস্ট এক্ট্রেস ইন লীড রোল পাবে, সেদিন তোমার ছেলে তোমার সাথে স্টেজে উঠবে। ততোদিন পর্যন্ত এই দুনিয়াতে তোমার আমার স্ক্রিপ্টের সাথে এডজাস্ট করতে হবে। কিছু করার নেই পিও। এই নাটক শেষ হলে আমি তোমাকে জান্নাতে নিয়ে আসবো। সেটা হবে তোমার জন্য আলটিমেট হ্যাপি এন্ডিং।
তুমি সূরা দ্বুহা পছন্দ করো। দ্বুহা থেকে অরিজিনেট হওয়া নাম রেখেছো বাবুনের। জোহা। জিজিজোয়ির ছোট্ট বাবুন জোহা। তোমার লাইট, তোমার রেডিয়েন্স। তোমার জোহা। দুনিয়ার বুকে তোমার হ্যাপি এন্ডিং।
জোহাকে আমি আমার কাছে নিয়ে নিলাম। শুধু এটা বুঝানোর জন্য যে দুনিয়াতে কোনো হ্যাপি এন্ডিং হয়না। যেদিন আমার কাছে আসবে সেদিনই ওকে মন ভরে চুমু খেতে পারবে। ততোদিন জমিনে তুমি নাটক করো। তোমার দরকার শুধু সাপোর্ট। তোমাকে উপর থেকে আমি সাপোর্ট দিবো, আর নিচে আমার জমিনের প্রত্যেকটা মহিলা সাপোর্ট দিবে। সবই আল্লাহর ইচ্ছা। তুমি শুধু সুস্থ হও দ্রুত। বেশি বেশি ফ্রুটস খাও। আর কিলিগবাজি করো। এই বাসায় তোমার আরো পাঁচটা বাচ্চা আছে। মন খারাপ হলে ওদের চুমু খেয়ে নিও। আপাতত ব্রেইনের উপর চাপ বেশি নিও না। তোমার ব্রেইনের তার ছিড়া।
তাছাড়া, তোমার ডাকনাম প্রিয়াপু রাখলাম। ফেসবুকের সব শারীরিক, বাস্তবিক, মানসিক মা হারা বাচ্চা তোমারে এখন থেকে আম্মা/আম্মি/আম্মু ডাকবে। যার যেটা ইচ্ছা হয়। তুমি চিল করো। আপাতত বিদায়। চুমু নিও।💋♥️"
আমার জোহা,
আমার সোনাপাখি জোহা,
আমার কলিজার টুকরা না, আমার পুরো কলিজাই তুমি। আমার পুরা দুনিয়া তুমি, আমার মা তুমি, আমার পাখি তুমি, আমার জিজিজোয়ির ভাই তুমি, আমার সাহস তুমি, আমার সাইনশাইন, আমার আলো, আমার ভালোবাসা, আমার আত্মা, আমার প্রেতাত্মা, আমার অন্ধকার, আমার সাহস, আমার রাগ, আমার জিদ, আমার ঘৃণা, আমার ক্ষোভ, আমার অসহায়ত্ব, আমার প্রার্থনা, আমার অনুরোধ, আমার চিৎকার, আমার আবদার সব তুমি, সব সব সব সব সব সব সব সব সব তুমি। ইউনিভার্স থেকে আমার একটাই চাওয়া ছিলো। একটা সুন্দর গুলুমুলু ছেলে বাবুন। ফেসবুকে প্রিয়াপুর ভক্ত সবাই তোমার খাম্মি হয় পাখি।
উমরাহতে গিয়ে চাইলাম, দুনিয়ায় যতোজনের সাথে দেখা হলো সবাইকে বলে বলে দুয়া করায়েও চাইলাম।
রাস্তার পেগু পেগু কুকুরবাচ্চাদের বিস্কুট ঘুষ দিয়ে দিয়ে চাইতাম। জিজিজোয়িকে বলতাম "তোদেরকে এতো বছর ধরে নিজের টাকা দিয়ে খাওয়াচ্ছি, আল্লাহকে অন্তত একটু মেও মেও করে বল একটা ভাই দিতে!"
জোহা পাখি, আমার বাবুন। আমার ছেলে! আমার পাখি!! আমার কলিজা বাচ্চা!
সাতাশ বছরের এডজাস্টমেন্টস, একটা কমপ্লিট ইউটেরাইন রাপচার, বারো বছরের এন্ডোমেট্রিওসিস স্ট্রাগল, এক বছর বাচ্চা নেয়ার ট্রিটমেন্ট, এরপর ফাইনালি তুমি পেটে আসার পর আট মাসের মধ্যে অন্তত চল্লিশটা স্যালাইন, বারোটা আয়রন ইনফিউশন, সতেরোটা প্রজেস্টেরন শট নেয়ার পর, পুরো প্রেগন্যান্সির একা একা খালি বাসায় কাটায়, র্যান্ডমলি ফ্লোরে পাসড আউট হয়ে পড়ে থাকার পর আবার উঠে গিয়ে নিজের খাবার নিজে রেডি করে খেয়ে, সাথে চিটাইংগা ফ্যামিলি চোদাইন্না রেওয়াজ অনুযায়ী নিজের সাতমাসের খাবার নিজে একা একা দাঁড়ায় দাঁড়ায় রান্না করে দুইটা পাঁচ বাটির টিফিন ক্যারিয়ারে ভরে তোমার দাদারবাড়িতে পাঠায়, অক্টোবরের ১৮ তারিখ রাত ২টা থেকে পরদিন অক্টোবরের ১৯ তারিখ সকাল ১২টায় আমাকে অপারেশন থিয়েটারে নেয়ার আগ পর্যন্ত মিনমিন করে কন্টিনিউয়াসলি জিকিরের মতো "আমাকে বাঁচান, আমার বাচ্চাটাকে বাঁচান বলতে বলতে মরে গিয়ে, আবার সেখান থেকে আল্লাহর দয়ার আর বান্দার কিলিগবাজিতে বেঁচে ফিরে আসার পর, ২১ তারিখ বাদ মাগরিব আমার হাতে প্রথমবারের জন্য তোমাকে কোলে তুলে দেয়া হইসে।
আমার কোলে নেয়া লাগসে তোমার ডেডবডি।
এই দুনিয়াতে আমার আর কিছু দেখার বাকি নাই বাবা।
এই দুনিয়াতে আমার শোনারও কিছু বাকি নাই।
এই দুনিয়াতে আমি বেঁচে আছি শুধু কথা বলার জন্য। আর কিলিগবাজি করার জন্য।
আমার কলিজা, তুমি উপরে নানাভাই আর Tahmina Liza খাম্মির বিল্লু মেটেন ভাইয়ের সাথে খেলু খেলু করো। তোমার দাদাবাড়ির সব লোক সবর করুক।
জমিনে যা যা করতে হয়, আল্লাহর ইচ্ছায় সব তোমার মা করবে।
আল্লাহর ইচ্ছায় তুমি বাঁচোনাই, কিন্তু এই বাসায় তোমার বাকি ভাইবোনরা বাঁচবে। হাসবে। খেলবে। ছোটো আম্মু ওদের জন্য জান দিয়ে দিবে ইনশাআল্লাহ।
০১.১১.২০২৫
১০.৩৩টা।