20/04/2025
একজন ডাক্তার হিসাবে রোগীকে চিকিৎসা দেওয়াই আমাদের কাজ। কখনো কখনো প্রাত্যহিকতার আবহে জীবন বড় একঘেয়েমি হয়ে ওঠে। একজন ডাক্তারের জীবনে সবথেকে বড় পাওনা একজন মুমূর্ষু রোগীর চোখের সামনে সুস্থ হয়ে ওঠা। যে পরিবার তাদের প্রিয়জনের সুস্থ হয়ে ওঠার সমস্ত আশা প্রায় ত্যাগ করে ফেলেছে, তাদের মনে আশা সঞ্চার করা। এর থেকে বড় আনন্দ বোধহয় পৃথিবীতে আর কিছু নেই। সেই আনন্দবোধ থেকেই এই পোস্ট। এর আর কিছু মানে নেই। আরামবাগের মতো ছোট্ট মফস্বল শহরে, যেখানে আমরা বড় শহরের পরিকাঠামো থেকে অনেক দূরে কাজ করি। আমাদের প্রতিনিয়ত অনেক অপমান সহ্য করতে হয়। তার একমাত্র কারণ আমাদের এখানে হাতের কাছে সবকিছু পাওয়া যায় না। সাপোর্টিং স্টাফ, ইন্সট্রুমেন্ট, ইনফ্রাস্ট্রাকচার সবকিছুরই অভাব। কিন্তু তবুও আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাই।
কয়েকদিন আগে বদনগঞ্জ এলাকার মুকুল বক্সী নামে এক 46 বছরের যুবক আমার আন্ডারে আস্থা মাল্টিস্পেশালিটি হসপিটাল ভর্তি হয়। প্রায় এক সপ্তাহ আগে থেকে ক্রমশ তার পা, পরে হাত, এবং তার ওপরে মুখের মাংসপেশি অবশ হয়ে যেতে থাকে। রোগীকে নিয়ে তারা প্রথমে আরামবাগের একজন ডাক্তার বাবুকে দেখান। তার পরামর্শমত তারা রোগীকে নিয়ে প্রথমে বর্ধমান মেডিকেল কলেজে নিয়ে যান। রোগীর অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে থাকে। একসময় তার শ্বাস-প্রশ্বাসের পেশিগুলো অবশ হয়ে যেতে থাকে। তাকে ভেন্টিলেশনে দেয়া হয়।তারপর তারা পেশেন্টকে নিয়ে বর্ধমানের ই একটি বেসরকারি নার্সিংহোমে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসার খরচ তারা বহন করতে না পেরে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আমাদের আরামবাগের মত জায়গায় এই ধরনের পেশেন্টের চিকিৎসার কতটা সুযোগ হবে তা জেনে আমি প্রথমেই তাদের নিরাশ করে কলকাতা নিয়ে যাওয়ার কথা বলি। কিন্তু তারা তখন প্রায় কপর্দক শূন্য। অগত্যা তাকে নার্সিংহোমে যতটা সম্ভব কম পয়সায় চিকিৎসা দেওয়ার জন্য ভর্তি করি।
খুব আশ্চর্য হয়ে যাই এটা দেখে, প্রায় দশ দিন হয়ে গেছে অথচ পেশেন্টের স্পেসিফিক ডায়াগনোসিস হয়নি। পেসেন্ট আমাদের কাছে আসে ভেন্টিলেশন নিয়ে। প্রায় একদিনের মধ্যে খুব দ্রুততার সঙ্গে আমি এবং আমার অত্যন্ত কাছের বন্ধু একজন নিউরোলজিস্ট এর সহায়তায় আমরা ডায়াগনোসিস করি পেশেন্ট জিবি সিনড্রোমে আক্রান্ত। জিবি সিনড্রোম বা গুলেন বেরি সিনড্রোম একটি অত্যন্ত জটিল রোগ। যাতে ক্রমশ পা হাত মুখের মাংসপেশী এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের মাংসপেশী বিকল হয়ে যেতে থাকে। শেষে পেশেন্ট শ্বাস নিতে না পেরে মারা যায়। এই রোগের চিকিৎসা হিসেবে দেয়া হয় ইমিউনোগ্লোবিউলিন। যা আরামবাগে পাওয়া যায় না। কিন্তু রোগীর আত্মীয়রা এই পেশেন্টকে বাঁচানোর জন্য এতটাই মরিয়া ছিল যে তারা প্রায় প্রতিদিন কলকাতায় গিয়ে গিয়ে ইমিউনোগ্লোবিউলিন আমাদের এনে দেয়। আমাদের প্রতি অগাধ বিশ্বাস মাঝেমাঝে আমাদের মনে বিশ্বাস হারানোর এক অদ্ভুত ভয় তৈরি করতো। পেশেন্ট প্রায় সাত দিন ভেন্টিলেশনে ছিল। ইমিউনোগ্লোবিউলিন তাকে দেয়া হলো প্রায় পাঁচ দিন। তার সঙ্গে সঙ্গে ফিজিওথেরাপি। নিউরোলজিস্ট ডাক্তারবাবু যখনই আরামবাগ এসেছেন রোগীকে দেখে গেছেন, এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়েছেন। খুব অদ্ভুতভাবে পাঁচ দিন পর থেকে পেশেন্টের উন্নতি হতে শুরু করে। প্রথমে পেশেন্টের হাতের মুভমেন্ট শুরু হয়। তারপর পেশেন্টের মুখের মাংসপেশি সবল হতে থাকলে পেশেন্ট খাওয়া-দাওয়া শুরু করে। ভেন্টিলেশন থেকে পেসেন্টকে মুক্ত করা হয়। পেশেন্ট আস্তে আস্তে কথা বলা শুরু করে। প্রায় ১২ দিন পর পেসেন্টকে ছুটি করা হয়। এরমধ্যে পেশেন্ট আবার ভেন্টিলেশনে থাকার কারণে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়, তারও চিকিৎসা হয় ।
পাঁচ দিন পরে মুকুল আমার চেম্বারে দেখাতে আসে। এখন সে নিজের হাতে খেতে পারছে, উঠে বসতে পারছে, পরিষ্কার কথা বলতে পারছে। মুকুল ওদের ফ্যামিলির একমাত্র রোজগেরে। সে স্বপ্ন দেখছে ভবিষ্যৎ সে আবার কাজ করবে। আমরাও আশা রাখছি। মুকুলের বাড়ির লোক আমাদের প্রতি যে বিশ্বাস দেখিয়েছে তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। মুকুল কে ভালো করার যে আনন্দ, সেই আনন্দ উপভোগ করার সুযোগ তারা করে দিয়েছে আমাদের। মুকুলের আরো দ্রুত সুস্থতা কামনা করি। এই পোস্ট আমাদের বড়াই করার জন্য না। শুধুমাত্র একটা আনন্দ ভাগ করে নেয়ার জন্য। আমরা আরামবাগের ডাক্তাররা সুযোগ পেলে, সঠিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার থাকলে, সর্বোপরি বাড়ির লোকের সহযোগিতা পেলে, এর থেকেও অনেক অলৌকিক কিছু করতে পারি। আমাদের উপর ভরসা রাখুন। প্রতিদিন এই আরামবাগ শহরে যত নার্সিংহোম বা হসপিটাল আছে, এইরকম অনেক মুমূর্ষু রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে। আমরা এবং আমাদের ডাক্তার বন্ধুদের ও নার্সিং স্টাফেদের নিরলস প্রচেষ্টায়। আমরা যারা আরামবাগে ডাক্তারি করি এবং যারা কলকাতা বা বড় বড় শহরে ডাক্তারি করেন আমরা একই জায়গা থেকে পড়াশোনা করেছি। একই পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেছি। কাজেই জ্ঞানের জায়গায় বা অভিজ্ঞতার জায়গায় আমরা কিছু কম না। আমাদের যেটা অভাব সেটা সাপোর্টিং স্টাফ, সাপোর্টিং ইন্সট্রুমেন্ট, সাপোর্টিং ইনফ্রাস্ট্রাকচার আর রোগীর আত্মীয়ের বিশ্বাস। একশ্রেণীর দালাল যারা কলকাতায় বা বড় জায়গায় রোগী ভর্তি করে কমিশন পায়, তাদের প্রতিনিয়ত প্রচেষ্টা থাকে আমাদেরকে অপমান করা ছোট করে দেখানো। তাতে আখেরে তাদেরই লাভ।
নিচে কতগুলো ভিডিও দিলাম। ভিডিওগুলো প্রথম তোলা হয়েছে মুকুল ভর্তি হওয়ার ৫ দিন পর থেকে। তার আগে মুকুলের কন্ডিশন আরো খারাপ ছিল। সমস্ত ছবি এবং ইনফরমেশন মুকুলের এবং মুকুলের বাড়ির লোকের অনুমতি নিয়েই দেওয়া হলো।