09/11/2019
।। উৎকল ব্রাহ্মণদের "ষন্নিগ্রহী/সন্নিগ্রহী " পদবী বিষয়ে কিছু কথা।।
আমাদের উৎকল ব্রাহ্মণ সমাজে "ষন্নিগ্রহী/সন্নিগ্রহী" একটি বিশিষ্ট পদবী। মূলতঃ সিমলাপাল অঞ্চলেই এই পদবীধারীদের বসবাস। পশ্চিমের দিকে এই পদবীর মানুষ দেখা যায় না। নিজেদের পদবীর বানান এঁদের অনেকেই ষন্নিগ্রহী, আবার কেউ কেউ সন্নিগ্রহী লেখেন। একটি পদবীর দুই রকম বানান লেখা দেখেই মনে প্রশ্ন আসে। কি কারনে সন্নিগ্রহীর জায়গায় ষন্নিগ্রহী লেখা হচ্ছে, কেউ এ ব্যাপারে আলোকপাত করলে সুবিধা হয়। আমি এখানে অনেকের মতোই জিজ্ঞাসু মাত্র। এই রকমই আমাদের মধ্যে একই পদবীর দুই রকম বানান নায়ক/লায়েক এ দেখা যায়। ......আমি এখানে আমার কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলি। ওড়িশায় থাকাকালীন প্রায় ২০/২১ বৎসর পূর্বে একটি ওড়িয়া মাসিক পত্রে পদবী বিষয়ে একটি লেখা চোখে পড়ে। সেখানে "সন্ধিবিগ্রহিক মহাপাত্র" পদবীটি কি রকম ভাবে অপভ্রংশ( মূল থেকে বিকৃত) হয়ে সন্নিগ্রহ-সন্নিগ্রহী-সনিগ্রহ ইত্যাদি রূপ নিয়েছে, তা লেখা হয়েছিল। প্রাচীন কাল থেকেই হিন্দু রাজগন কর্মানুসারে তাঁদের রাজ্যের কর্মচারীদের বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত করতেন। সেই ভাবেই হোতা (যজ্ঞের পুরোহিত),ত্রিপাঠী (তিন বেদের জ্ঞাতা,অপভ্রংশ হয়ে তিআড়ি,তিহাড়ি,তেওয়ারী), পতিশর্মা (মুখ্য ব্রাহ্মণ), শতপথী/সৎপতি (শুক্ল যজুর্বেদের শতপথ ব্রাহ্মণের জ্ঞাতা), ষড়ঙ্গী (বেদের ছয় অঙ্গের জ্ঞাতা) ইত্যাদি পদবী এসেছে। এই রকম রাজদত্ত বহু পদবী ওড়িশার বিভিন্ন জাতির মধ্যে বর্তমান সময়েও রয়েছে। যেমন রাউতরায়(অশ্বারোহী মুখ্য),চম্পতিরায়(ছোট সৈন্যদলের প্রধান), শত্রুশল্য(যাঁর বাণ শত্রুর পক্ষ্যে শেল স্বরূপ), গড়নায়ক( দুর্গের প্রধান), মহারথী/মার্থী, বাহুবলেন্দ্র, বলিয়ারসিংহ,মান্ধাতা, মর্দরাজ, হরিচন্দন ইত্যাদি অনেক পদবী রয়েছে।১২০৩ খৃস্টাব্দে বঙ্গদেশ মুসলিম করতলগত হয়। তার প্রায় চারশত বৎসর পরে ১৫৬৮ খৃস্টাব্দে গজপতি মুকুন্দদেবের পতনের ফলে উৎকল দেশ পাঠান শাসনের অধীন হয়েছিল। সেদিক থেকে দেখলে উৎকল দেশ বহুকাল আপন স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে পেরেছিল। স্বল্পকাল পাঠান দৌরাত্ম্যের পর উৎকল মুঘল শাসন ভুক্ত হয়। তবে স্বল্পকালের পাঠান দৌরাত্ম্য উৎকলে এক গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে। পাঠান সেনাপতি কালাপাহাড় কর্তৃক পুরীর শ্রীমন্দিরসহ ভুবনেশ্বর ও জাজপুরের বিখ্যাত মন্দিরগুলি লুন্ঠিত ও দেব মূর্তি সমূহ নষ্টিকৃত হয়। মুঘল শাসনে মহারাজ মানসিংহের সুবাদারিত্ব কালে দেশে শান্তি ফেরে। আঞ্চলিক শাসনভার তখন পূর্বতন হিন্দু শাসকগনের হাতেই থাকে।মুঘল শাসনের শেষভাগে বাংলার সুবাদার বা নবাবের হাত থেকে ওড়িশা যায় নাগপুরের মারাঠা ভোঁসলের হাতে ১৮৫১ খৃস্টাব্দে। মারাঠা থেকে ১৮০৩ খৃ. এ ব্রিটিশ ক্ষমতা দখল করে। সুতরাং হিসেব করে দেখলে উৎকল দেশ ১৫৬৮ থেকে ১৭৫১ পর্যন্ত মোট ১৮৩ বৎসর কাল সরাসরি মুসলিম শাসনের অধীন ছিল। এই শাসন কেবল মাত্র "মোগলবন্দী" অঞ্চল বা উপকূলবর্তী বৃহত্তর বালেশ্বর, কটক ও পুরী জেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। পাহাড় ও অরণ্য বেষ্টিত ওড়িশার দুর্গম অভ্যন্তরভাগের শাসকগণ এক প্রকার স্বাধীন ছিলেন। এই রকম রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ওড়িশায় পৌরাণিক সংস্কৃতির বা হিন্দুয়ানীর ধারাটি লুপ্ত হতে পারেনি। তাই সেখানে পূর্বতন পদবীগুলিও লোপ পায় নি। বাংলায় দীর্ঘ মুসলমান শাসন আমলে বহু নতুন নতুন পদবীর আমদানি হয়েছে, যেমন: মজুমদার, তরফদার, জমাদার, তালুকদার, খাঁ, পোদ্দার,মুন্সী, চাকলাদার,মল্লিক ইত্যাদি। ওড়িশায় এই রকম পদবী দেখতে পাওয়া যায় না। যাইহোক , আমার কথায় ধান ভানতে শিবের গীত এসে যাচ্ছে। তাই আসল কথায় আসি।......... বর্তমান ওড়িশার দক্ষিণ ভাগ পূর্বতন কলিঙ্গ রাজ্য ছিল। খৃস্টীয় ত্রয়োদশ ,চতুর্দশ শতাব্দীতে কলিঙ্গরাজ নরসিংহদেব ও নিশঙ্ক ভানুদেবের রাজত্বকালে প্রখ্যাত সংস্কৃত কবি ও "সাহিত্য দর্পন" কার বিশ্বনাথ কবিরাজ, কলিঙ্গরাজের সভাকবি ও মন্ত্রী ছিলেন। বিশ্বনাথ এবং তাঁর পিতা চন্দ্রশেখর উভয়েই কলিঙ্গ রাজ কর্তৃক "সন্ধিবিগ্রহিক মহাপাত্র " উপাধিতে ভূষিত হন। (সন্ধি =সমঝোতা, বিগ্রহ=যুদ্ধ, মহাপাত্র =মহামন্ত্রী) প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর এই পদে থেকে তাঁরা রাজাকে যুদ্ধ ও শান্তির বিষয়ে পরামর্শ দান ও সন্ধির জন্য দৌত্য কার্য্য করতেন। জ্ঞানী ব্রাহ্মণের পক্ষে দৌত্য কার্য্য করা অপেক্ষাকৃত সহজ ছিল। কারণ হিন্দু নিয়মানুসারে দূত এবং ব্রাহ্মণ অবধ্য,তাছাড়া বিদ্বান হিসেবে সর্বত্র তাঁরা বিশেষ মর্য্যাদার অধিকারী ছিলেন। তাই বিপক্ষ রাজার শিবিরে গিয়েও তাঁরা পান্ডিত্য ও যুক্তি দ্বারা তাঁদের শান্তির পক্ষে বোঝাতে সমর্থ হতেন। তৎকালীন রাজগণ প্রদত্ত এই সন্ধিবিগ্রহিক মহাপাত্র পদবীটি বংশানুক্রমিক ও কিছুটা বিকৃত হয়ে বর্তমানে সন্নিগ্রহী/ষন্নিগ্রহী রূপ ধারণ করেছে বলে আমার মনে হয়। হতে পারে বর্তমান সন্নিগ্রহী/ষন্নিগ্রহী গনের পূর্বপুরুষ উৎকলের গজপতি মহারাজার সন্ধিবিগ্রহিক মহাপাত্র ছিলেন। আমার ওড়িশায় বাস কালে "সন্ধিবিগ্রহ" পদবীরধারী বহু মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। এ ব্যাপারে অনেকেই নিজ মত প্রকাশ করবেন ,এই আশা রাখছি।.......বহুকথা হল, এখন সবাইকে নমস্কার জানিয়ে ইতি টানছি।