07/07/2021
ফ্যারাডের বামহস্ত নীতি মনে পড়ে? ১৮৫৫ সাল তখন, বামহস্ত নীতির আবিষ্কারক বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডে স্টিমবোটে চড়ে লন্ডন থেকে হাঙ্গারফোর্ড ব্রিজে যাচ্ছেন, টেমস নদীর ওপর দিয়ে। নদীতে ভাটা তখন, অস্বচ্ছ বাদামী জল ঠেলে টেমস এর দুর্গন্ধ এসে লাগছে ফ্যারাডের নাকে। ফ্যারাডে হাতের সামনে থাকা সাদা রঙের কাগজের কার্ড ছুঁড়ে ফেললেন টেমসের জলে। দুপুর দেড়টা তখন, সাদা কার্ড টেমসের জলে ইঞ্চি খানেক ডুবতে না ডুবতেই মিশে গেল টেমসের বুকে। চকচকে রোদেলা আলোতেও সাদা কাগজকে আলাদা করে চিনে উঠতে পারলেন না ফ্যারাডে। এতোই অস্বচ্ছ টেমসের জল।
সেসময়ে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন ডিজরায়েলি। টেমস-এর দুর্গন্ধে নিজের অফিস ছেড়ে পালালেন তিনি একদিন, একহাতে জরুরি কাগজপত্রের বান্ডিল আর অন্যহাতে পকেটের রুমাল দিয়ে চেপে রাখা নাক। টেমস-এর তীর বরাবর বাড়িগুলোর জানলার পর্দা ক্যালসিয়াম হাইপোক্লোরাইটে চুবিয়ে দেওয়া হল, তবু লাভ হল না কিছু। গ্রিক পুরাণের জীবনপুরী আর প্রেতপুরীর মাঝে থাকা পুতিগন্ধময় Styx নদীর কথা মনে করে টেমসের ডাকনাম হয়ে গেল 'Stygian Pool'.
৭ই জুলাই, ১৮৫৫, ফ্যারাডে খোলা চিঠি লিখলেন বিখ্যাত 'দ্য টাইমস' পত্রিকায়, (অংশবিশেষ উদ্ধৃত করছি) "...If there be sufficient authority to remove a putrescent pond from the neighbourhood of a few simple dwellings, surely the river which flows for so many miles through London ought not to be allowed to become a fermenting sewer. The condition in which I saw the Thames may perhaps be considered as exceptional, but it ought to be an impossible state; instead of which, I fear it is rapidly becoming the general condition. If we neglect this subject, we cannot expect to do so with impunity; nor ought we to be surprised if, ere many years are over, a season give us sad proof of the folly of our carelessness." জনগণের মধ্যে তোলপাড় শুরু হল, ঘুম ভাঙল প্রশাসনের। 'The great sink' কে পরিষ্কার করার ভার পড়ল লন্ডনের মেট্রোপলিটন বোর্ড অব ওয়ার্কসের চিফ ইঞ্জিনিয়ার জোসেফ বাজালজেটের ওপর। ১৮৫৮ সালে লন্ডনে তৈরি হল নিকাশী ব্যবস্থা। গর্বোদ্ধত ব্রিটিশ শাসনের কেন্দ্রে, ক্ষমতার চূড়ায় বসে থাকা মানুষেরা প্রথম বুঝলেন পরিবেশের খেয়াল রাখার গুরুত্ব।
লন্ডনে শিল্পবিপ্লব তখন ঘটে গেছে, যা শহরের প্রাণধারার এই অবনমনের পিছনে অন্যতম কারণও বটে। শিল্পজাত পদার্থ ও উৎপাদনের উপজাত পদার্থের সঠিক ডিসপোজাল তখনো আয়ত্ত হয়নি সাধারণ মানুষের। এই অজুহাতে লন্ডনবাসী'কে ক্ষমা করা যায়। কিন্তু আমরা, হলদিয়াবাসীরা কি ক্ষমার অযোগ্য পাপ করছি না?
আজ ২০২১ এ দাঁড়িয়ে আছি আমরা, আদিম কলুষের ধারা আজও অব্যাহত। বিশ্বজুড়ে প্রতি মিনিটে প্রায় ১০ লক্ষ প্লাস্টিকের জলের বোতল ফেলছি আমরা। ৫ ট্রিলিয়ন (5,000,000,000,000) সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ফেলা হচ্ছে প্রতি বছরে। আমরা প্রতি বছর প্রায় ৩ হাজার লক্ষ টন প্লাস্টিক বর্জ্য জমা করছি এবং এই বিপুল প্লাস্টিক বর্জ্যের মধ্যে ৮০ লক্ষ টন প্লাস্টিক সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে। আমাদের গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র প্রায় ৭২৮৪৫ টন প্লাস্টিক বয়ে চলেছে প্রতি বছরে। পরিসংখ্যান বলছে, এভাবে চলতে থাকলে ২০৫০ সালে দাঁড়িয়ে বিশ্বজুড়ে সমুদ্রে মাছের থেকে প্লাস্টিকের পরিমান বেশি হবে, আর আমাদের ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক মাছের পেট ঘুরে আমাদের ডিনার টেবিলে এসে উঠবে।
হাত দিয়ে খুঁটে তোলা যায় না, হলদিয়া নদীপাড় ঠিক তেমনই অতি ক্ষুদ্র প্লাস্টিকে ভরে ছিল কাল। সঙ্গে থার্মোকলের চায়ের কাপ, খৈনি-সিগারেট-চিপসের প্যাকেট তো ছিলই। কোভিডের বিরুদ্ধে হলদিয়ার ছেলেমেয়েরা কাল খেয়াঘাট থেকে নদীপাড়ে বসার প্রথম ঘাট পেরিয়ে দ্বিতীয় ঘাট পর্যন্ত নদীর পাড় বরাবর আবর্জনা পরিষ্কার করলাম। কত স্মৃতি ছড়িয়ে আছে এই ঘাসে মাঠে। শৈশবের রবিবারে বাবা মায়ের হাত ধরে ঘুরতে যাওয়ার অসীম উত্তেজনা থেকে প্রথম কৈশোরের স্কুল কেটে হলুদ বিষণ্ণ বিকেলে ব্যাগ কাঁধে উবু হয়ে বসে থাকা, সবের সাক্ষী নদীপাড়। 'হলদি' শুধু এ শহরের নামের অংশীদার নয়, আজও কৈশোরের 'বন্ধু চল'-এর ঠিকানা হলদি, দিনমজুরের সীমিত সাধ্যে মেয়ে-বউয়ের মনোরঞ্জনের অহংকার হলদি, নবযুগলের প্রেমকুঞ্জের অধিকার হলদি। ভবিষ্যতের জন্য এই নদীপাড়কে, নদীকে সুস্থ রেখে যাওয়া আমাদের দায়িত্ব, কর্তব্য। ভাবীকালের প্রতি এই কর্তব্যের কথা মনে করিয়েছিলেন ফ্যারাডে এক জুলাই মাসের ৭ তারিখ, আরেক ৭ তারিখে আমরা আমাদের ভাগের দু'কলি লিখে গেলাম। সুস্থ থাক এই পৃথিবীর সমস্ত নদীরা, ফেলে আসা সময়ের চিহ্ন ধরে চিরসবুজ থাকুক নদীপাড়েরা। এ আমাদের দায়িত্ব, আগামীর 'কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার'।
তথ্যসূত্র:
১) The Life and Letters of Faraday (1870); Vol. 2; 358
২) Banning single-use plastic: lessons and experiences from countries” UN Environment report (2018); 4-7, 56