11/07/2025
তারকার মৃত্যু ও Glutathione
শিশুটি জন্মাল । এক মাস--দু'মাস-দু'বছর --তার বয়স বাড়ছে। বয়স বাড়ছে কিন্তু। প্রতিদিন। পৃথিবীর কেউ কি চাইবেন কোনো ওষুধ দিয়ে তার এই স্বাভাবিক বৃদ্ধিকে রোধ করে দিতে? আঠেরো -কুড়ি-পঁচিশ পর্যন্ত বয়স বাড়ুক। যা সবাই চায় ।তারপর যেন আর বয়স না বাড়ে! অধিকাংশ মানুষ মনে মনে রাজা যযাতির জিন বহন করেন --যৌবন চাই । শরীরের বয়সবৃদ্ধি প্রক্রিয়া থমকে থাক --এই আজকাল সবার ঈপ্সিত ধন। আর গায়ের রঙ? আমাদের দেশে কে আর তাতে সন্তুষ্ট ?
চার থেকে চুরাশি --যত পেশেন্ট আসেন আমাদের কাছে , বিশেষতঃ মহিলা --নিজের রোগটি দেখানোর পর ছোট্ট করে গোপন কথাটি বলেন --"আর একটু Skin Brightening Cream লিখে দেবেন ? " কেউ তো আবার শুধু এই কারনেই চেম্বারে নাম লেখান। নিজের পুরো মাস মাইনে রুমালে বেঁধে গৃহকর্মসহায়িকা মেয়ে,আদিবাসী রমনী,কলেজ পড়ুয়া,ষাটোর্ধ গৃহবধূ --কে নয় ?
এ আঁধার কাটবার নয় । আমরা না লিখলেও বাজারে দোকানে অঢেল OTC Product ! স্টেরয়েড মেশানো মলম মেখে এক দু 'মাসের গ্লো নিয়ে বোঁওও করে চক্কর কেটে পার্টিতে ঘোরাঘুরি করে এনারা আমাদের কাছে আসেন । তখন মুখ ভর্তি ব্রণ, আবাঞ্ছিত লোম, কালো ছোপ ইত্যাদি সারাতে আমাদের কালঘাম ছুটে যায় ।। বিউটিফিলিয়া বা গ্লোফিলিয়া ব্যাপারটা এই পর্যন্তই ছিল।
এর মধ্যে "কাঁটা লগা গার্ল" অকালে প্রয়াত হলেন। যা বিপুল বেগে এখন খবর ছোটে--বাপ্রে !! এটাও এখন রেট্রো নিউজ ! যেমন রেট্রো হয়ে গেছে আমেদাবাদে প্লেন ভাঙা বা পহেলগাঁও। অত জোরে ছুটে খবর থেকে পালাতে পারিনা --মনে লেগে থাকে। তাই মাঝরাতে এসব ছাঁইপাশ লিখতে বসি।
অত্যন্ত দুঃখজনক যে কোনো মৃত্যু।
দেশের সব কটি নামী খবরের কাগজে দেখা গেল--শেফালী জরিয়ালা হঠাৎ কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে মৃত্যুর পর জানা গেছে তিনি নিয়মিত Glutathione ট্যাবলেট খেতেন। তাঁর ঘরে দু বোতল এই ট্যাবলেট ও দুটি Glutathione injection এর Vial পাওয়া গেছে। যে যৌগের নামটা একটু আড়ালে আবডালে ছিল --শেফালীর মৃত্যুতে তা জনসমক্ষে চলে এল ।।
আজ আমার চেম্বারে এক অজ গ্রামের মেয়ে এনে দেখাল--এই ওষুধটা খাই আমি। অনলাইনে আনিয়েছি। দেখি--Glutathione Tablet. কি আশ্চর্য ! রাজার ঘরে যে বিষ আছে টুনির ঘরে সে বিষ আছে !
কি এই Glutathione ?
একটি ট্রাইপেপটাইড রাসায়নিক যৌগ। Glycine, Cysteine, Glutamic Acid এই তিনটি অ্যামিনো অ্যাসিড থেকে কিছু এনজাইমের সাহায্যে লিভারে স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াতেই মানুষের শরীরের মধ্যে তৈরি হয় । 1888 সালে এই যৌগটি আবিষ্কার করেন J.de Rey Pallhade , 1952 সালে নিউইয়র্কে Glutathione ল্যাবরেটরিতে কৃত্রিমভাবে প্রস্তুত করা সম্ভব হল । শরীরের বিভিন্ন কোষে Glutathione এর অনেক ভালো প্রভাব আছে ।
এটা আসলে একটা Antioxidant , অর্থাৎ শরীরে প্রতিনিয়ত যেসব ক্ষতিকারক পদার্থ তৈরি হচ্ছে তা বিনাশ করে । লিভার , কিডনি,স্নায়ুতে বেশ কিছু ভালো কাজ করে। এই সব কারণে যৌগটি বাজারে আনার কথা ভাবা হয়েছিল।
2023 সাল থেকে Glutathione এর মার্কেটিং শুরু হয় । এমন কি কিছু নামী কোম্পানিও 2023 সালের সেপ্টেম্বর মাসে Glutathione সম্পর্কে উৎসাহিত হয়ে এগিয়ে আসে ।
অথচ তারও আগে 2016 সালের অগাস্ট মাসে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে Glutathione এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নিয়ে সচেতন করে একটা আর্টিকল লেখা হয়েছিল।
সবচেয়ে বড় সত্য হল আজ পর্যন্ত কিন্তু Glutathione ভারতে FDA দ্বারা অনুমোদিত ওষুধ নয় । কারণ এখন পর্যন্ত অনুমোদনের সপক্ষে যথেষ্ট গবেষণাভিত্তিক কোনো তথ্য কারো হাতে নেই !
একটা যৌগপদার্থ নিয়ে এত কেন মাতামাতি ? এত কেন ঢাক ঢাক গুড় গুড় ?
কারণ এই যৌগ ত্বক ফর্সা করে। আমরা যে কারনে কালো , যে কালো রঙ আমাদের অনেক অসুখের সুরক্ষাকবচ --সেই মেলানিন তৈরি করা বন্ধ করে দেয় গ্লুটাথিওন। শুধু এই ক্ষমতার জন্য যৌগটির চাহিদা এশিয়াতে তুঙ্গে। প্রতি বছর ঝড়ের গতিতে বেড়ে চলেছে এর মার্কেট গ্রোথ।
এর ক্ষতিকারক দিক যা এখন পর্যন্ত জানা আছে --মারাত্মক অ্যালার্জি, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি। ইনজেকশন বা বেশি ডোজে খেলে শরীরের কোন অরগানে ঠিক কি ক্ষতি হয় তা এখনো পুরোপুরি জানার সময় আসেনি । অথচ ঘরে ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে anti aging, fairness medicine হিসেবে।
শরীরে স্বাভাবিক ভাবে যেটুকু গ্লুটাথিওন দরকার সেটুকুই তৈরি হয়, স্বাভাবিক খাবারের মধ্যে যেটুকু গ্লুটাথিওন তৈরির উপাদান থাকে সেটুকুই উপকারি তার বেশি নয় । ট্যাবলেট বা ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে কৃত্রিমভাবে গ্লুটাথিওন ঢোকালে তা চুপ করে বসে থাকবে না --শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার মধ্যে দাপাদাপি করে কি যে ঘটায় --অনেকটাই অজানা এখনো।
এসব কথা কে কাকে বোঝাবে কেই বা বুঝবে এখন ? ভয়ানক রক্তাল্পতা ,ষোলো বছরের মেয়ে-- মা এসে বলেন --আমার মেয়ে কোনো খারাপ জিনিষ খায় না, শুধু আমলা জুস আর চিয়া সিডস খেয়ে থাকে-তবু, কেন এত কম হিমোগ্লোবিন বলুন তো? এর কি উত্তর দেব ?আমাদের কোন ঠাকুর্দা দিদিমা শুধু চিয়া সিডস খেয়ে বাঁচত জানিনা । কর্পোরেট বাজার নেট দুনিয়ায় ভর করে যা মাথায় ঢোকাবে তাই চিরস্থায়ী বাকি সব নশ্বর ।
পুঁজিবাদের বিজ্ঞাপন বহুবছর ধরে বুঝিয়ে আসছে -- প্রাণের চাইতেও সৌন্দর্য দামী !
Glutathione এর ক্ষেত্রে একেবারে হাতে হাতে ফল। সুতরাং --এ যৌবনরোধী জলোচ্ছাস রুধিবে কে ?
এবার প্রশ্ন --এত যখন প্রশ্ন এমন ওষুধ বাজারে এল কেন ? উত্তর--
Cisplatin নামে ক্যান্সারের ওষুধে মারাত্মক কিডনির ক্ষতি হয় । Glutathione সেই কিডনির ক্ষতি অনেকটাই প্রতিরোধ করে। ফিলিপিনসে শুধু Cisplatin ব্যবহারকারী রোগীদের জন্য গ্লুটাথিওন FDA অনুমোদন প্রাপ্ত ওষুধ । ভালো নয় ? সেই পুরোনো কথা --ছুরি দিয়ে ফল কাটাও যায় খুন করাও যায়। আগুন তো আলো দেয় আবার পুড়িয়ে মারে । যে যেভাবে ব্যবহার করবে।
এবার ভাবুন--সঠিক কিছু না জেনে, ডাক্তারের পরামর্শ না নিয়ে শুধু ফর্সা হবার জন্য কি জীবনের ঝুঁকি নেবেন ?
(ছবি --ইন্টারনেট)
ডঃ Sharmistha Das লিখলেন