09/07/2025
অজ্ঞান-তিমিরান্ধস্য জ্ঞানাঞ্জন-শলাকয়া।
চক্ষুরুন্মীলিতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ।।
অখন্ড-মন্ডলাকারং ব্যাপ্তং যেন চরাচরম্।
তত্পদং দর্শিতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ।।
গুরুর্ব্রহ্মা গুরুর্বিষ্ণুঃ গুরুর্দেবো মহেশ্বরঃ।
গুরুরেব পরং ব্রহ্ম তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ।।
#গুরু_পূর্ণিমা
আষাঢ়ী পূর্ণিমাকে সাধারণভাবে সনাতন ধর্মে গুরু পূর্ণিমা বলে। এদিন ব্যাসদেবের জন্মতিথি।তিনি বেদের বিভাগ করেছিলেন, তাই তাঁকে বেদব্যাস বলাহয়। এই তিথিতে ব্যাসদেবের পূজা করা হয়। তিথিটিকে তাই গুরু পূর্ণিমা বলে ধরা হয়। গুরুদেবের এই দিনে বিশেষ করে পূজার্চনা করা হয়।তাঁর কথা, তাঁর বাণী, তাঁর আদেশ বিশেষ করে স্মরণ মনন করা হয়। গুরু শরীরে থাকলে তাঁর কাছে বসে তাঁর কথা শুনতে হয়।
গুরু কে? গুরু আমাদের পথ দেখান। অন্ধকার থেকে যিনি আলোর পথ নির্দেশ করেন, তিনি গুরু।
'গু' শব্দের অর্থ অন্ধকার, আর 'রু' শব্দের অর্থ আলো। যিনি অন্ধকার থেকে শিষ্যকে সত্যের পথ
আলোকিত করেন, তিনি গুরু।
মানুষ যখন জন্মায়, তখন থেকেই জীবনের শেষ পর্যন্ত কেউনা কেউ গুরু থাকেন। তবে তাঁরা কেউ মা বাবা;গার্হস্থ্য জীবনের গুরু। কেউ শিক্ষক; ছাত্র অবস্থার গুরু। যিনি উপনয়নের মন্ত্র বলে দেন তিনি আচার্য গুরু। তবে অধ্যাত্ম জগতের পথ যিনি দেখান তিনি আধ্যাত্মিক গুরুদেব। তাঁর দেখান পথেই সাধনা করতে হয়। মনপ্রাণ দিয়ে জপ ধ্যান করলে ভগবানে প্রীতি আসে। ঠাকুরের কথায় তাঁর কাছে একপা এগিয়ে গেলে তিনি দশ পা এগিয়ে আসেন। এই আধ্যাত্মিক গুরুকে নিয়েই আজকের
আলোচনা।
যখনই আত্মার ধর্মলাভের আগ্রহ প্রবল হয়, তখনই ধর্মশক্তি-সঞ্চারক পুরুষ সেই আত্মার সহায়তার জন্য অবশ্যই আসবেন, এসেও থাকেন। যখন গ্রহীতার ধর্মালোক আকর্ষণ করবার শক্তি পূর্ণ ও প্রবল হয়, তখন সেই আকর্ষণে আকৃষ্ট আলোকশক্তি অবশ্যই এসে থাকে।
গুরুশিষ্য উভয়ের সম্বন্ধেই কতকগুলি পরীক্ষা আবশ্যক।শিষ্যের এই গুণগুলি আবশ্যক—পবিত্রতা, প্রকৃত জ্ঞানপিপাসা ও অধ্যবসায়। অশুদ্ধাত্মা পুরুষ কখনও ধার্মিক হতে পারে না। কায়মনোবাক্যে পবিত্র না হলে কেউ কখনও ধার্মিক হতে পারে না। শিষ্যকে বিনীত হতে হবে, উদ্ধত নয় । স্বামী বিবেকানন্দ একটি চিঠিতে আলাসিঙ্গাকে লন্ডন থেকে লিখছেন 1895 সালে 18 নভেম্বর , ''....Guru-Bhakti is the foundation of all spiritual development...."।শুধু ধর্মকথা শুনলে আর ধর্মপুস্তক পড়লেই যথেষ্টভাবে প্রমাণিত হয় না যে, হৃদয়ে ধর্মপিপাসা প্রবল হয়েছে এবং যতদিন না আমরা প্রবৃত্তির উপর জয়লাভ করতে পারি, ততদিন সদাসর্বদা অভ্যাস ও আমাদের পাশব প্রকৃতির সাথে নিরন্তর সংগ্রাম আবশ্যক। উহা দু-এক দিনের কর্ম নয়, কয়েক বৎসর বা দু-এক জন্মেরও কর্ম নয়; শত শত জন্ম ধরে এই সংগ্রাম চলতে পারে।
গুরুকে চিনবো কী করে? স্বামী বিবেকানন্দ পরবর্তীকালে গুরু চেনার কিছু উপায় আমাদের বলেছেন শাস্ত্রীয় পথ অনুসরণ করেই -- "শ্রোত্রিয়’—যিনি বেদের রহস্যবিৎ, ‘অবৃজিন’—নিষ্পাপ, ‘অকামহত’—যিনি তোমাকে উপদেশ দিয়া অর্থসংগ্রহের বাসনা করেন না, তিনিই শান্ত, তিনি সাধু। পরম পুজনীয় স্বামী ভূতেশানন্দজীর কথায়:
'গু' শব্দের অর্থ হল অন্ধকার, 'রু' শব্দের অর্থ নিরোধক।অন্ধকার বা অজ্ঞানকে যিনি নিরুদ্ধ করেন তাকে গুরু বলা হয়।
গুরুস্তোত্রে আছে:
অজ্ঞানতিমিরান্ধস্য জ্ঞানাঞ্জনশলকয়া ।
চক্ষুরুন্মীলিতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরবে নম:।।
--- অজ্ঞানতিমিরে আচ্ছন্ন ব্যাক্তির চক্ষুকে যিনি জ্ঞানরুপ শলাকা দ্বারা উন্মোচিত করেন -- তিনিই গুরু ।
গুরুকে বাজিয়ে নেবার কথা আছে। অবশ্য আমাদের মত সাধারণের পক্ষে তা হয়তো সম্ভব নয়। নরেন্দ্রনাথ দত্ত, পরবর্তীকালে স্বামী বিবেকানন্দ, তাঁর গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের প্রতি ষোলো আনা বিশ্বাস আনতে ঠাকুরের জীবনের প্রায় অন্তিম পর্ব পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। আমাদের মত সাধারণের গুরু নির্বাচনের আগে গুরুই শিষ্য নির্বাচন করেন।
গুরুর কাছে দীক্ষা 'গ্রহণ' করা নয়, দীক্ষা 'পাওয়া'। গ্রহণ করার ক্ষমতা আমাদের আছে নাকি? তাই পাওয়া বলাই ঠিক। তাঁর কৃপা থাকলেইতো পাওয়া যায়।অবশ্য রামকৃষ্ণ পরিমন্ডলে যাঁরা দীক্ষা প্রদান করেন, তাঁরা নিজেকে গুরু বলেননা। তাঁরা বলেন ঠাকুরই সব। স্থূল দেহে একজন দীক্ষা দান করলেও আসলে সবই ঠাকুর।
দীক্ষামন্ত্র গুরু যেভাবে দেখিয়ে দিয়েছেন ও বলে দিয়েছেন ঠিক ঠিক সেভাবে নিয়মিত জপ ধ্যান করতে পারলে, আমাদের বিশ্বাস ভগবানে প্রীতি আসবেই। অবশ্য একটা কথা আছে, জপ ধ্যান পাঠ কিছুই কিছু নয়, যদি তাঁর কৃপা না থাকে। পরম পূজনীয় স্বামী ভূতেশানন্দজী বলছেন,গুরুর কৃপা হয় গুরুকে ভালবাসলে।এখন বলবে ভালবাসা কি করে হয় , না, ভালবাসতে বাসতে। গুরু সান্নিধ্যে থাকলে উপকার হয়। প্রায় কিছু কিছু তাঁর কথামত শাস্ত্র অধ্যায়ন করলে মন ঈশ্বরময় হয়ে থাকে, মন ভালো থাকে, প্রাণে শান্তি বোধ হয়। শাস্ত্রপাঠও একরকম সাধু সঙ্গ।আমরা যেমন প্রত্যহ খাবার পর বাসন মাজি, ঠিক সেই রকম সাধুসঙ্গ বা গুরু সঙ্গ করলে মন মার্জিত হয়, সংস্কৃত হয়।শ্রীরামকৃষ্ণ দেব বলতেন, সকলেরই গুরু সেই এক সচ্চিদানন্দ।
গুরুকে শুধুমাত্র স্থূল মানবদেহ ভাবলে হবেনা। তাঁকে ভাবতে হবে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর রূপে। একবার গুরুরূপে কাউকে মেনে নিলে তাঁর ওপর বিশ্বাস রাখতে হয়। বিশ্বাস আর ভালোবাসা সঙ্গে জপ-ধ্যান সাধনা সচ্চিদানন্দ লাভের উপায় হয়। ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণদেব বলেছেন, মানুষের প্রধান উদ্ধেশ্য ভগবান লাভ। ভগবান লাভ হলতো সব হলো।
স্বামী বিবেকানন্দ সানফ্রান্সিসকোয়, 29 মার্চ,1900 সালে একটি বক্তৃতায় বলেছেন, তুলে দিলাম,"....My dearest and nearest relative in life is my Guru; next, my mother; then my father. My first reverence is to the Guru. If my father says, "Do this", and my Guru says, "Do not do this", I do not do it. The Guru frees my soul. The father and mother give me this body; but the Guru gives me rebirth in the soul..." ভাবা যায়! গুরুর প্রতি চরম বিশ্বাস জন্মালেই এই কথা বলা যায়।
আমাদের সকলের বিশ্বাস, এ জন্মে না হোক পরবর্তী কোনো জন্মে আমরা সকলে ভগবান লাভ করবই। এ বিশ্বাস আমাদের মনে শক্তি যোগাবে। গুরুর কৃপা থাকলে আমাদের সাধন পথে কোনো কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবেনা। এছাড়া কোনো পথও নেই।
'নান্য পন্থা বিদ্যতে অয়নায় '।