11/12/2024
কর্মচক্র
আমাদের জীবনে যারা যারা আমাদের সাথে খুব গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কে জড়িয়ে থাকেন ,যেমন - বাবা,মা,স্বামী/স্ত্রী,সন্তান অথবা অন্যান্য খুব কাছের আত্মীয়স্বজন ,তাঁরা কোন না কোনভাবে আমাদের সাথে অতীত জীবনেও সম্পর্কে থেকেছেন।কর্মচক্রে তারা বারবার রূপ বদলে ফিরে আসে এবং ভুল করে অথবা পূর্বকৃত ভুলের মাশুল দেয় ভালবাসা দিয়ে।প্রকৃতির যে অমোঘ নিয়ম পূর্ব জীবনে মৃত্যুযন্ত্রণা ও বর্তমান জীবনের জন্মযন্ত্রণার রূপ নিয়ে এসে আত্মার পূর্ব জীবনের স্মৃতি ভুলিয়ে দেয়ে ,সেটা এক পরম আশীর্বাদ।এই বিস্মৃতিই আমাদের সাহায্য করে শত্রুতা ভুলে ভালবাসতে।চরম আঘাতকারী ভয়ানক শত্রুও যখন জন্ম পার হয়ে শিশু রূপে অসহায় হয়ে সামনে আসে,মানুষ তার স্বাভাবিক দৈবী প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে তাকে মন থেকে ভালোবাসে,পালন করে।সেই শত্রুও শত্রুতা ভুলে কৃতজ্ঞতায় নিজের পাপস্খলন করে(যদিও সব ক্ষেত্রে তা ঘটে না)।আজকের পূর্ব জীবনের অভিজ্ঞতা তেমনই এক কর্মচক্রের কাহিনী।
সময় টা গত বছর বর্ষাকাল।শাঁওলি(নাম পরিবর্তিত) এসেছিল আমার কাছে past life regression এর জন্য।প্রচন্ড স্ট্রেস,নেগেটিভ চিন্তা এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে মাঝে মাঝেই অসুবিধার সমস্যা নিয়ে।কাউন্সেলিং এর সময় বুঝলাম যে শাঁওলির থ্রোট চক্রে সমস্যা আছে।বেশ বড় একটা অপারেশনও হয়েছে কিছু বছর আগে।চক্র ব্যালান্সিং এর খুব দরকার।মূল পাস্ট লাইফ সেশনে যাবার আগে চক্র ব্যালান্সিং মেডিটেশন করার পর বেশ কিছুটা ভাল ফল হয়।সেই সময় আমাকে শাঁওলি বলে যে অভ্যাসের জন্য যে মেডিটেশনের গাইড অডিও পাঠিয়েছিলাম সেটার সাথে ধ্যান করতে গেলেই একটা সোনালি চুলের মেয়েকে ও দেখতে পাচ্ছে আর ওর বাবা আর কাকাকে যারা ওর পিছু পিছু ধাওয়া করছে একটা মাঠের মধ্যে দিয়ে আর ও বেশ ভয় পাচ্ছে,হঠাৎ গলায় টান পড়ছে আর খুব যন্ত্রণা শুরু হচ্ছে।পরে পরে সেটা এত বেশি বার হয় যে মূল সেশনের দিন অন্য কিছু না ভেবে ঐ ভিসন টাকেই ধরে আমরা পূর্ব জীবনের যাত্রায় এগোই।
পূর্ব জীবনের স্মৃতি যখন উঠে আসা শুরু হয় তখন প্রথমেই শাঁওলি দেখে সে একটা ১৬-১৭ বছর বয়সি সোনালী চুলের মেয়ে।ফুলে ভরা বিশাল মাঠে একটা সাদা ফ্রকের মত জামা পরে দাঁড়িয়ে আছে।সামনেই তাদের বিশাল প্রাসাদোপম পুরোনো ব্রিটিশ আমলের মত একটা বাড়ি।বাড়িতে মাতৃসমা একজন গভার্নেস আছেন,তিনি গাউন পরিহিতা।এই জীবনে শাঁওলির নিজের মা কে পূর্ব জীবনের ঐ স্নেহশীলা গভার্নেস হিসাবে সে চিনতে পারে।তার বিশাল বাড়িতে অনেকরকম পশু পাখি।রয়েছে সাদা লোম ওয়ালা কুকুর,খরগোশ,নানারকম পাখি,বাড়ির বাইরের ঘোড়াশালে তেজি কালো ঘোড়া। সোনালি চুলের মেয়েটির নাম ছিল এলসা (যে এই জীবনে হয়েছে শাঁওলি)।এলসার বাবা-মা মারা গেছেন।বাবার ছবি দেখে সে চিনতে পারে এই জীবনে তার পিতৃসম স্নেহপরায়ণ শ্বশুর মশাই ছিলেন পূর্ব জীবনের পিতা। আর তার মেয়েকে পূর্ব জীবনের মা হিসাবে চিনতে পারে ছবি দেখে।(এই জীবনেও তার মেয়ে ছোট্ট বয়স থেকেই তাকে অভিভাবকের মত আগলে রাখে)।
সময় এগোতে থাকে।এলসা অসম প্রেমে পড়ে তাদের ঘোড়া তদারকির কাজে ন্যস্ত সুপুরুষ সহিসের।ছেলেটির সুন্দর স্বভাব,বাদামি-লাল জ্যাকেট,কাউবয় হ্যাট আর বুট পরা চেহারা এলসার মনে দোলা দিয়ে যায়।শাঁওলি এক মুহূর্তে চিনে নেয় এই সহিস ছেলেটিই এই জীবনে তার স্বামী যাকে সে আজও একইরকম ভালোবাসে আগের জীবনের মত।এলসা একদিন কথা বলছেতার প্রিয় সহিস বন্ধুর সাথে আর পাহারা দিচ্ছে আরেক বন্ধু(এই জীবনেরও বন্ধু সেই বন্ধু টি)।এমন সময় অতর্কিতে প্রবেশ করে দুজন এবং এলসার বন্ধু ও প্রেমিক কে প্রচন্ড মারধোর করতে থাকে।সহিস ছেলেটিকে মারতে মারতে সরিয়ে নিয়ে যায় আক্রমণকারী দুজন ।প্রচন্ড অবাক হয়ে শাঁওলি সেই দুজনকে চিনতে পারে তার এই জীবনের বাবা ও কাকা হিসাবে। এই লোকদুটি চায় না এলসা সহিসকে বিয়ে করুক।বিত্ত ও আভিজাত্যের এত তফাতে বিয়ে বা সম্পর্ক করলে সমাজে কলঙ্ক হবে আর তা এই সমাজশোধনকারীরা মেনে নেবে না।খুব অশান্তি চলতে থাকে।এলসা একা ঘরে না খেয়ে বসে বসে কাঁদতে থাকে।বাগানে একা বসে থাকে। দিন কয়েক পরে সেই দুজন আবার আসে।এবার তাদের উদ্দেশ্য অন্য।বিপুল সম্পত্তির মালিক অনাথ মেয়েটির থেকে জোর করে সই করিয়ে সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে তারা।সই না করলে প্রিয় সহিস বন্ধুকে খুন করার হুমকি দেয় তারা।মাতৃসমা গভার্নেস ও বাড়ির পুরোনো পরিচারকেরা অনেক চেষ্টা করে ঐ দুজনকে আটকানোর।কিন্তু শেষরক্ষা হয় না।খুনের হুমকির সামনে এলসা নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং সই করে দেয়।দুর্বৃত্তেরা এবার একে খুন করে গভার্নেস ও সাহায্য করতে আসা এলসার প্রেমিক সহিসকে।এরপরেই স্মৃতিপটে ফুটে ওঠে সেই দৃশ্য যা শাঁওলি বারবার দেখেছিল প্র্যাকটিস অডিও ক্লিপ চালানোর সময়।একটা মাঠের মাঝখান দিয়ে ছুটে চলেছে সে,সোনালি চুল এলোমেলো হয়ে উড়ছে।পিছনে ছুটতে ছুটতে আসছে সেই দুজন।হঠাৎ গলায় পড়ল টান।প্রচন্ড জোর ফাঁস চেপে বসে গেল আর চাপ আলগা হল প্রাণটা পুরোপুরি নিয়ে নেওয়ার পর।
প্রাণ চলে যাবার সময় শেষবারের মত সহিস বন্ধুকে কাছে পাওয়ার ইচ্ছা নিয়ে এলসা ইহজগত ত্যাগ করল।মৃত্যুর সময় তার মৃত বাবা-মা তাকে নিতে এসেছেন সে দেখতে পেল। উপর থেকে সে দেখল যে সহিস,গভার্নেস আর এলসার শরীর গুলোকে মাঠে পুঁতে দিল দুবৃত্তেরা।
কিন্তু পাপ চাপা থাকে না। এলসার বাবার পরিচিত ক্ষমতাবান লোকেরা খবর পেয়ে দূর দেশ থেকে ছুটে আসে।তারা ঐ শরীর গুলো খুঁড়ে বের করে সসম্মানে ফুল দিয়ে সাজিয়ে সমাধিস্থ করে।দুর্বৃত্ত দুইজন কে তারা গাছে বেঁধে আগুন লাগিয়ে দেয় এই ভয়ঙ্কর অপরাধের শাস্তি স্বরূপ।
আত্মিক জগতে গিয়ে এলসা ওরফে শাঁওলি এবং তার কাছের দুই মানুষ দিব্য আলোকে স্নাত হয়।এই জীবনে স্বামী এবং মা রূপে তারা ফিরে আসে তার কাছে।সেই দুই দুর্বৃত্তরা নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয় এবং সুদে আসলে নিজেদের ভুল শোধরানোর জন্য শাঁওলির বাবা এবং কাকা হিসাবে এই জীবনে ফিরে আসে আর স্নেহের অঙ্কে শোধ করে চলেছে তাদের ঋণ।শাঁওলির গলায় যেখানে এই জীবনে অপারেশন করার প্রয়োজন পড়েছিল করাল কর্কট রোগের প্রকোপে ঠিক সেখানেই গত জীবনে মৃত্যুফাঁস এসে চেপে বসেছিল।সেই এনার্জি ব্লক হয়ে রয়ে গিয়েছিল সূক্ষ্ম ভাবে। শাঁওলি সেশন শেষে আমাকে বলেছিল যে ও ছোটবেলায় যখন জন্মেছিল তখন ওর চুল একদম সোনালি “সোনপাপড়ি”-র মত।গতজীবনে করা ভুলে ফলে এই জীবনে শাঁওলির বাবার বহু বছরের পরিশ্রমের ফলে গড়ে তোলা দোকান হাতছাড়া হয়ে যায় একজনের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে।তার কাকা জঘন্য ভাবে প্রেমে প্রতারিত হন এবং বর্তমানে প্রবল শ্বাসকষ্ট(পূর্ব জীবনে একজন নির্দোষ মানুষ কে শ্বাসরোধ করে মারার ফল) ও অন্যান্য দেহকষ্টে ভোগেন।