17/09/2025
অন্তরের দিকদর্শন (THE INNER COMPASS):
শক্তি, মন ও উদ্দেশ্যের জাগরণ
আশিষ কুমার দাস
আমাদের প্রত্যেকের ভেতরে একটি স্বর আছে—একটি নিস্তব্ধ, শান্ত স্বর, যা প্রায়শই ডুবে যায় সন্দেহ, বিভ্রান্তি আর ভয়ের কোলাহলের ভেতর। ছোটবেলা থেকেই আমাদের অনেককে বলা হয়েছে, আমরা কী করতে পারব না, কোথায় পৌঁছতে পারব না, আমরা কতটা দুর্বল। স্বামী বিবেকানন্দ এক জায়গায় লিখেছিলেন—
“ছোটবেলা থেকে আমায় দুর্বলতা শেখানো হয়েছে, জন্ম থেকেই শুনেছি আমি দুর্বল। তাই নিজের শক্তিকে আজ অনুভব করতে আমার খুব কষ্ট হয়। কিন্তু বিশ্লেষণ আর যুক্তির মাধ্যমে আমি জ্ঞান অর্জন করি, নিজের শক্তিকে চিনতে শিখি, উপলব্ধি করি।” (সম্পূর্ণ রচনা, খণ্ড ২, পৃ. ৩৩৯)
এই শক্তি জাগরণের সংগ্রাম কেবল স্বামীজীর নয়—এ সংগ্রাম প্রতিটি পরীক্ষার্থী ছাত্রের, প্রতিটি ক্রীড়াবিদের, প্রতিটি কর্মীর, যে এক অনিশ্চিত চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সত্য একটাই—আমরা দুর্বল নই, আমরা অজানা শক্তির ভাণ্ডার। স্বামীজীর কথায়—
“আজ পর্যন্ত যে সমস্ত জ্ঞান মানুষ অর্জন করেছে, তা কোথা থেকে এসেছে? সবটাই মানুষের ভেতর থেকে। বাইরে কী আছে? কিছুই না… কেউ কোনো জ্ঞান সৃষ্টি করে না; মানুষ তা নিজের অন্তর থেকে নিয়ে আসে।” (সম্পূর্ণ রচনা, খণ্ড ২, পৃ. ৩৩৯)
আমাদের যুগের আসল সমস্যা জ্ঞানের অভাব নয়—সমস্যা হল স্পষ্টতার অভাব, মনোযোগের অভাব, আর অন্তর্দিকের দিশার অভাব। আমরা ডেটায় ঘেরা, অথচ জ্ঞানের জন্য ক্ষুধার্ত। আমরা সাফল্যের পেছনে ছুটি, কিন্তু উদ্দেশ্যকে ভুলে যাই। তাই আজ স্বামীজীর আহ্বান আমাদের জন্য আগের চেয়ে অনেক বেশি জরুরি—
“মনসংযোগই জ্ঞানের ভাণ্ডারের চাবিকাঠি।” (সম্পূর্ণ রচনা, খণ্ড ২, পৃ. ৩৯১)
তিনি আরও বলেছিলেন—“আমার কাছে শিক্ষার প্রকৃত অর্থ হল মনসংযোগ, তথ্য সঞ্চয় নয়।” (সম্পূর্ণ রচনা, খণ্ড ৬, পৃ. ৩৮)
ভাবুন তো, যদি প্রতিটি তরুণ শেখে শুধু মুখস্থ নয়, মনোযোগ দিতে… শুধু প্রতিযোগিতা নয়, সহযোগিতা করতে… শুধু সফল নয়, উদ্দেশ্যপূর্ণ নেতৃত্ব দিতে—তবে কীভাবে বিশ্ব বদলে যাবে।
আমাদের জাগিয়ে তোলা গল্পগুলো
দেখুন তাতিয়ানা ম্যাকফ্যাডেনের গল্প। রাশিয়ার এক অনাথাশ্রমে জন্ম, হুইলচেয়ারের সুযোগ ছিল না। ছয় বছর ধরে সে হাতের ভর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে চলেছে। পরে আমেরিকায় দত্তক নেওয়া হয়, কিন্তু সেখানে তাকে স্বাগত জানানো হয়নি—পেয়েছিল অপমান, বঞ্চনা আর ব্যথা। তবু সে দমেনি। খেলাধুলার ভেতর খুঁজে পেয়েছিল নিজের দিকদর্শন, কঠোর অনুশীলনের মাধ্যমে তৈরি করেছিল নিজের পথ, আর হয়ে উঠল সতেরো বার প্যারালিম্পিক পদকজয়ী। যাকে বিশ্ব দুর্বলতা বলেছিল, তাকেই সে রূপান্তর করল শক্তিতে।
অথবা নিন ইন্দ্রা নুই-এর গল্প। চেন্নাইয়ের শ্রেণিকক্ষ থেকে যাত্রা শুরু করে তিনি পৌঁছলেন নিউ ইয়র্কের বোর্ডরুমে। পেপসিকোর সিইও হিসেবে তিনি ঐতিহ্য আর আধুনিকতাকে মিলিয়েছেন, করুণা আর সাহসকে একত্র করেছেন। তাঁর নেতৃত্ব প্রমাণ করেছে—স্বকীয়তা আর সহনশীলতাও কৌশলের মতোই শক্তিশালী। তিনি নিজের অন্তরের দিকদর্শন শুনেছিলেন, আর পুনঃসংজ্ঞায়িত করেছিলেন নেতৃত্বের মানে।
এগুলি কেবল সাফল্যের গল্প নয়—এগুলি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমরা যে দিকদর্শন খুঁজে ফিরি, তা বাইরে নয়। তা আমাদের ভেতরেই আছে। একবার যখন তাকে জাগিয়ে তোলা যায়, তখন কোনো বাধাই অতিক্রমের বাইরে থাকে না।
আমাদের শতাব্দীর সাতটি টানাপোড়েন
জ্যাক দ্যলোর্স-এর নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক শিক্ষা কমিশন ২১শ শতাব্দীর সাতটি বড় টানাপোড়েনের কথা বলেছিল—
• বিশ্বায়ন ও স্থানীয়তা – কীভাবে আমরা বিশ্বনাগরিক হবো, অথচ নিজের শিকড় হারাবো না?
• সার্বজনীন ও ব্যক্তিগত – কীভাবে বিশ্বায়নকে গ্রহণ করব, অথচ স্বকীয়তা হারাবো না?
• ঐতিহ্য ও আধুনিকতা – কীভাবে পরিবর্তনকে স্বাগত জানাবো, অথচ ঐতিহ্যকে ফেলে দেবো না?
• দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি – কীভাবে ধৈর্যের কৌশল খুঁজব, এমন এক যুগে যেখানে তাত্ক্ষণিক ফল চাই?
• প্রতিযোগিতা ও সমতা – কীভাবে উৎকর্ষ আর ঐক্যকে সমানভাবে মূল্য দেবো?
• জ্ঞানের বিস্তার ও তা আত্মস্থ করার ক্ষমতা – কীভাবে অসীম তথ্য আয়ত্ত করব, অথচ স্পষ্টতা হারাবো না?
• আধ্যাত্মিক ও বস্তুগত – কীভাবে বহুত্ববাদকে সম্মান করব, অথচ জীবনকে উচ্চতর স্তরে উন্নীত করব?
এই প্রতিটি টানাপোড়েনই আজকের যুবকদের কাছে এক একটি পথবিচ্ছেদ। আর প্রতিটি পথে প্রয়োজন বাড়তি বিভ্রান্তি নয়, বরং দৃঢ় মনোযোগ; বাড়তি শব্দ নয়, বরং অন্তরের দিকদর্শন।
কেন এই আলোচনা প্রয়োজনীয়
এই আলোচনা শুধু তত্ত্বের জন্য নয়। এই আলোচনা জীবনের জন্য। এই বই সেই ছাত্রদের জন্য, যারা পরীক্ষার চাপে দমবন্ধ বোধ করে। এই আলোচনা সেই ক্রীড়াবিদদের জন্য, যারা রোদে অনুশীলন করে, পড়ে গিয়ে উঠে দাঁড়ায় আর আবার লড়ে। এই আলোচনা সেই পেশাদারদের জন্য, যারা অনিশ্চিত এক দুনিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে—যেখানে চাকরি হঠাৎ হারিয়ে যায়, আবার নতুন শিল্প হঠাৎ জন্ম নেয়।
The Inner Compass-এর বার্তা সরল, অথচ প্রবল—সমস্ত শক্তি, সমস্ত জ্ঞান, সমস্ত স্পষ্টতা ইতিমধ্যেই তোমার ভেতরে আছে। স্বামীজীর আশ্বাস আমাদের সাহস দেয়—
“আজ পর্যন্ত যে জ্ঞান পৃথিবীতে এসেছে, সব এসেছে মন থেকে; মহাবিশ্বের অসীম গ্রন্থাগার রয়েছে তোমার নিজের মনের ভেতরে।” (সম্পূর্ণ রচনা, খণ্ড ১, পৃ. ২৮)
আমাদের কাজ বাইরের আলো ধার নেওয়া নয়, ভেতরের প্রদীপ জ্বালানো। যদি আমরা মনকে মনোনিবেশ করতে শেখাই, আবেগীয় বুদ্ধিমত্তাকে লালন করি, আর সাহস নিয়ে কাজ করি—তাহলে শিক্ষা, খেলাধুলা আর কর্মজীবন আর আলাদা চ্যালেঞ্জ নয়; বরং হয়ে উঠবে সেই মঞ্চ, যেখানে আমরা নিজেদের সর্বোত্তম রূপ প্রকাশ করব।
এই রচনা সেই যাত্রার আমন্ত্রণ। এটি এক আহ্বান—তোমার ভেতরের দিকদর্শনকে জাগিয়ে তুলতে, সময়ের টানাপোড়েনগুলোকে দৃঢ়তার সঙ্গে অতিক্রম করতে, আর সফল নয় কেবল—বরং উদ্দেশ্যপূর্ণ হতে। গুণাবলির নেতা হতে, মহৎ অভিপ্রায়ের মানুষ হতে।