16/05/2020
ঘন ঘন বদলাচ্ছে করোনা, জিনের গঠন পাল্টে ফেলছে পরপর ২০০ বার, সামনে এল সেই ছবি
সাড়ে সাত হাজার কোভিড পজিটিভ রোগীর নমুনা থেকে ভাইরাল স্ট্রেন আলাদা করে খুঁটিয়ে তাদের কার্যকলাপ দেখেছেন ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডনের (ইউসিএল) বিজ্ঞানীরা। মাইক্রোস্কোপের নীচে ফেলতেই চমক। কেউ গোলমুখো, কেউ আবার ডিম্বাকার। মাইক্রন সাইজের ভাইরাসের চারদিকে খোঁচা খোঁচা কাঁটার মতো অংশ। এই খোঁচাগুলোই হল স্পাইক গ্লাইকোপ্রোটিন। এই খোঁচার জন্যই ভাইরাসের এমন নাম করোনা যা এসেছে ‘ক্রাউন’ অর্থাৎ মুকুট থেকে।
এসব তো গেল। কিন্তু আসল চমকটা হচ্ছে ভাইরাসের প্রতিলিপি তৈরি করে সংখ্যায় বাড়ার প্রক্রিয়াটা। যতবারই সে তারই মতো আরও একটা ভাইরাস তৈরি করেছে, ততবারই জিনের গঠন বদলে ফেলেছে নিমেষে। এই বদলটা হয়েছে পরপর, খুব দ্রুত। একটা ভাইরাসের জিনোম (ভাইরাল জিন) থেকে তৈরি হচ্ছে আর একটা, তার থেকে আবার আরও একটা। এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকছে। আর আশ্চর্যের ব্যাপার হল, প্রতিটা জিনোমই একে অপরের থেকে আলাদা। কারণ প্রতিবারই প্রতিলিপি বা নিজের মতোই আরও একটিকে তৈরি করার সময় জিনের গঠন বদলে ফেলেছে ভাইরাস।
কাকে বলে জেনেটিক মিউটেশন?
এই জিনের গঠন বদলানোর প্রক্রিয়াকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে জেনেটিক মিউটেশন (Genetic Mutation) । সোজা কথায় বলতে গেলে, জিন ঠিক সেভাবে সাজানো থাকে তাকে ঘেঁটেঘুঁটে, আকার, বিন্যাস সব বদলে ফেলে আবার নতুন করে সাজিয়ে তোলা। জিনের বিন্যাস যদি বদলে যায়, তাহলে ভাইরাসের ধরনও বদলে যাবে। আপাত নিরীহ ভাইরাসও হয়ে উঠবে প্রাণঘাতী। ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডনের ভাইরোলজিস্টরা বলছেন, একসঙ্গে ২০০ বার জিনের গঠন বদলাতে দেখা গেছে এই ভাইরাসকে। প্রতিটা বদলেই সে হয়ে উঠেছে আরও সংক্রামক। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বদলে যাওয়া ভাইরাল জিনোমগুলি যদি পরপর বিশ্লেষণ করা হয়, তাহলে তার তল খুঁজে পাওয়া যাবে না। একেবারে শুরুতে সে কেমন ছিল, তখন তার মতিগতিও বা কেমন ছিল, কিছুই বোঝা যাবে না।
ভোলবদলের পিছনে আছে নিখুঁত ছক
ইউসিএল-এর গবেষক ফ্রাঙ্কোসিস ব্যালোক্স বলেছেন, এই বদলের আসল কারণ হল ভাইরাস মানুষের শরীর চিনে ফেলেছে। একবার মানুষের কোষের গন্ধ পেয়েই আরও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে। ভাইরাস বুঝে গেছে মানুষের শরীরের কোষে ঢুকতে পারলেই তার মাথা গোঁজার একটা বড়সড় ঠাঁই তো হবেই, আর শিকারও মিলবে অনেক। মানব শরীরের ফুসফুস দিয়েই শুরু হবে তার ভোজ, এরপরে খাদ্যনালী, লিভার, কিডনি, হার্ট তো রয়েছেই। অঙ্গে অঙ্গে ভোজ শুরু হয়ে যাবে তার।
এই বদলের আরও একটা কারণ হল, মানুষের শরীরে সেই বন্ধু প্রোটিনকে খুঁজে পেয়েছে ভাইরাস। এই ACE-2 প্রোটিনই হল যত নষ্টের গোড়া। মানুষের শরীরেই থেকে ভাইরাসের সঙ্গে দিব্যি বন্ধুত্ব পাতিয় ফেলেছে। ভাইরাসের বাহক হয়ে উঠেছে। খোঁচা খোঁচা ওই স্পাইক প্রোটিনগুলো দিয়েই এই ACE-2 বাহকের হাত ধরে ভাইরাস। তারপর সোজা ঝপ করে কোষে ঢুকে পড়ে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষের বেশিরভাগ অঙ্গের কোষেই রয়েছে এই প্রোটিন। তার আসল কাজ হল কোষের রক্ষা করা। অনেকটা দ্বাররক্ষীর মতো। অথচ সেই চুপিচুপি ভাইরাসকে কোষের ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে।
এখন ভাইরাসেরও একটা সীমাবদ্ধতা আছে। যে ভাইরাল স্ট্রেন ফুসফুসে ঢুকতে পারবে, সে চট করে লিভার বা হার্টের কোষে ঢুকতে পারবে না। শুরুতে তাই দেখা যাচ্ছিল সার্স-কভ-২ ভাইরাস ফুসফুসের সংক্রমণই বেশি ঘটাচ্ছে। ‘সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটারি সিন্ড্রোম’-এ আক্রান্ত হচ্ছে রোগী। সেই সঙ্গে সর্দি-কাশি, জ্বর, নিউমোনিয়ার উপসর্গ দেখা যাচ্ছে। পরে ভাইরাস দেখল এভাবে তো বড় মুশকিল! ধীরে ধীরে সে নিজেকে বদলাতে শুরু করল। এমনভাবে জিনের গঠন বদলালো, যে মানব শরীরের যে কোনও অঙ্গের কোষেই সরাসরি ঢুকে যেতে পারে সে। তাই এখন দেখা যাচ্ছে, ফুসফুস শুধু নয়, লিভার, কিডনি, হার্ট, খাদ্যনালী, এমনকি অন্ত্রেও ভাইরাল স্ট্রেনের খোঁজ পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। চিনের ভাইরোলজিস্টরা তো আবার বীর্যের মধ্যেও করোনা খুঁজে পেয়েছেন। অতএব দেখা যাচ্ছে, মানুষের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলিই এখন ভাইরাসের টার্গেট। প্রায় সব অঙ্গেই সংসার পেতে ফেলার কৌশল শিখে নিয়েছে এই ভাইরাস।
আরও একটা ব্যাপার দেখা যাচ্ছে সেটা হল, রোগের উপসর্গে বদল। এরও কারণ সেই জিনের গঠনে বদল। যত বদলাচ্ছে ভাইরাস, ততই উপসর্গেও বদল হচ্ছে। ফুসফুসে যখন ঢুকছে তীব্র শ্বাসকষ্ট দেখা দিচ্ছে, হৃদপেশীতে ঢুকে পড়লে আচমকা হার্ট অ্যাটাক হচ্ছে, আবার লিভার, পাকস্থলীতে বাসা বাঁধলে রোগের ধরনে বদল আসছে। বিজ্ঞানীরা তাই বলছেন, করোনার সংক্রমণে নতুন নতুন উপসর্গ ফুটে উঠছে রোগীর শরীরে।
তাই এখন দেখা যাচ্ছে, শ্বাসকষ্ট শুধু নয়, বুকে ব্যথা, পেটের সমস্যা, আচমকা হার্ট অ্যাটাক, ত্বকে রঙে বদল, ত্বকে চুলকানি, র্যাশ,কিডনি ফেলিওর, এমনকি রক্ত জমাট বেঁধেও মৃত্যু হচ্ছে রোগীর।
যত বেশি বাঁচবে, তত রোগ ছড়াবে
এই জিনের গঠন বদলের আরও একটা কারণ আছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এক শরীর থেকে অন্য শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পড়তে একসময় ভাইরাসও ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তার জীবনকাল ফুরিয়ে আসে। যেমনটা হয়েছিল এই সার্স-কভ-২ ভাইরাসের পূর্বসূরী অর্থাৎ সার্স-কভ-১ ভাইরাসের ক্ষেত্রে। সে নিজেকে তেমনভাবে গড়েপিঠে নিতে পারেনি। তাই একসময় সংক্রমণও থেমে গিয়েছিল। কিন্তু এই ভাইরাস অনেক বেশি চালাক। সে জানে একসময় তার জীবনকালও ফুরিয়ে আসবে। তাই যত দ্রুত সম্ভব নিজেকে বদলে গড়েপিঠে নিচ্ছে সে। জিনের গঠন বদলে যাওয়া ভাইরাসের শক্তি বেশি, কাজেই নতুন উদ্যোমে সে আবার সংক্রমণ ছড়াতে শুরু করছে। এইভাবেই এক মানুষের শরীর থেকে অন্য শরীরে সংক্রমণ এত তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়ছে। নতুন নতুন শরীর চিনে নিতে একটুও সমস্যা হচ্ছে না ভাইরাসের।
করোনা-চরিত্রে দুর্বল দিক দেখে ফেললেন বিজ্ঞানীরা
এই ভাইরাসেরও একটা দুর্বল দিক আছে যেটা চিহ্নিত করেছেন ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডনের বিজ্ঞানীরা। সেটা কী? গবেষকরা দেখলেন এই ভাইরাসের জিনোমের পুরোটাই বদলায় না। কিছু কিছু জায়গা থাকে যেখানে মিউটেশন হয় না। সেটাই হচ্ছে ভাইরাসের দুর্বল জায়গা। ড্রাগ বা ভ্যাকসিন যদি সেখানেই টার্গেট করা যায়, তাহলেই আর পালাবার পথ পাবে না ভাইরাস। এখন ভাইরাল জিনোমের সেই দুর্বল জায়গাগুলোকেই চিহ্নিত করছেন বিজ্ঞানীরা। এটাই হবে ভাইরাস মারার তুরুপের তাস। সাময়িকভাবে নয়, এই ভাইরাস থেকে মুক্তি পাওয়ার দীর্ঘমেয়াদী উপায়ের খোঁজ এভাবেই মিলবে বলে দাবি ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডনের বিজ্ঞানীদের।
সংগৃহীত