03/05/2024
#ডাক্তারিডায়রি
প্রার্থনার লেখনী 🙏© তীর্থ
ওর প্রায় ১৯ বছর আগে প্রথম পা গলা, হাত কাপা, সারা মুখ, পেট সব ফুলে গেছিলো। মানে শুরুটা হয়েছিলো এইভাবেই। কিডনির যে ছাঁকনি জালি টা আছে সেইটা কাজ করছিলো না। বেরিয়ে যাচ্ছিল প্রোটিন ইত্যাদি। আমরা এইটাকে নেফ্রটিক সিন্ড্রোম বলি। ছোটো বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এগুলো প্রায় কোনো সমস্যাই করে না। একটু চিকিৎসা করলে ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু সবার ক্ষেত্রে আবার এমনটাও হয়না। কারুর ক্ষেত্রে এই জালির ক্ষতি হতেই থাকে। শরীর না ফুললেও আস্তে আস্তে মৃত্যু ঘটতে থাকে কিডনির ছাঁকনির।
এই ডাইরি টা আমার এক পুরোনো রোগিণীর। আজ প্রায় ৫ বছর পর ওকে দেখে.... যাক, লিখি। আজ লিখতেই হবে। 😞
প্রথম ধরা পড়ে একটা অটো ইমিউন অসুখ। সেটা চামড়া, হাড় পেরিয়ে আঘাত হানে কিডনিতে। লুপাস নেফ্রপাথি। বয়েস মেয়েটির মেরে কেটে তখন চব্বিশ। এত তারাতারি এই অসুখের এই দিকে গতি নেওয়া দেখাও যায়না ।ওরা পাগলের মতন ঘুরতে থাকে এই বড়ো হাসপাতাল থেকে সেই বড়ো হাসপাতাল। কঠিন পরীক্ষা হয়। শুরু হয় কঠিন থেকে কঠিনতম ওষুধ। ইনজেকশন। সেই যুদ্ধে বাচ্চাটা জয়ী হয়ে যায় সে যাত্রা। দিনে পাঁচ খানা ওষুধ, সপ্তাহে ইনজেকশন, স্ক্যান , রেনোগ্রাম নিয়ে ও হার মানেনা। তখন জ্বর কাশি শ্বাসকষ্ট হলে আমার কাছে আসতো। আমিও তখন এমডি করছি, আমিও হাত পাকাতাম , জ্বর কাশি কমিয়ে। © তীর্থ
সেই ফুলের মতন মেয়েটা প্রেমে পড়ে। ওর বিয়ে যখন তখন আমি এমডি সেকেন্ড ইয়ার । তারপর কালের অতলে এই স্মৃতি গুলো হারাতে থাকে।
অনেকদিন পর আবার ওর ফলো আপ নিচ্ছি আমি। মেয়েটি, ওর মা আর ওর স্বামী। আমার কাচের টেবিলটার উপর আবার অনেক আগের মতন সেই বিশাল ইনভেস্টিগেশন ফাইল। টি ভি এস ই অন্তত সাত খানা। রিপোর্ট এর পর রিপোর্ট। এই প্রচণ্ড গরমে ও ৪০ নম্বর রোগিনী। আমার মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে। কানের পাশে আবার সেই পুরোনো অশনি সঙ্কেত এর জ্বালা শুরু হয়। APLs এর স্ক্রিনিং করতে দিয়েছিলাম। সেটা পজিটিভ🚨। অর্থাৎ এবারে শরীরের আরেক অদ্ভুত শত্রুতা তার নিজের ই প্রোটিন গুলোর সঙ্গে। লুপাস রুগীদের ক্ষেত্রে খুব কমন, মিশ্চারেজ হবে ... যাই হোক,কিন্তু.. ....
"স্যার, আমার টিভিয়েস টা একবার দেখবেন প্লিজ?"🥺
রিপোর্টায় চোখ বোলাতে থাকি। একটা ওভারিতে একটা সিস্ট সাথে এন্ডোমেট্রায়োসিস এর লক্ষণ হয়তো,কি জানি!। ৯ সেন্টিমিটার এর। রিপোর্টের ছবিটা কেমন যেনো মন খারাপ করা। সিস্টের মধ্যে অনেক ভাঁজ, অনেক কিছু দলা পাকিয়ে আছে। এইটা ভালো লাগে না আমার। এই লুকোনো রাক্ষস গুলোকে চিনি আমরা। ।© তীর্থ
"তোকে কটা ব্লাড টেস্ট দিচ্ছি করা দিকি। এই সিস্ট.. " আমি চুপ করে যাই।© তীর্থ
আজ রাত ৯:৪৫। ঘেমে নেয়ে কাজ করে চলেছি। নিজের মতন ছোট্ট রুগী গুলোর কিছু খারাপ হলে মন খারাপ করছি, ভালো হলে ছেলেমানুষের মতন ওদের সঙ্গে হাসছি।
ওরা জাস্ট ঢোকে। কাপা হাতে রিপোর্ট টা এগিয়ে দেয়।
সব কটা ক্যানসার মার্কার হাই। আমি চোখ বন্ধ করে নি। রেফারেল লিখতে শুরু করি। প্রথমে একজন গাইনী স্যার, একজন ক্যানসার সার্জন.. বমির ওষুধ দি। ফুলে যাওয়া জয়েন্ট গুলোর ওষধ দি। কেস হিস্ট্রি নি। হোমিওপ্যাথিক মেটেরিয়া মেডিকা ঘাঁটি কেমন একটা এলোপাথাড়ি করে....আমি আবার জ্যান্ত মড়ার পাথর হয়ে উঠি...
"স্যার, ক্যানসার তো? মানে এবার চুলটাও গেলো" ও অট্টহাস করে ওঠে। পরের মুহুর্তে সামলে নেয়। আজ ও একা এসছে। আমি বলি শোন, মনে হচ্ছেনা খুব ভয়ঙ্কর তুই দেখিয়ে....আর শোন একটা এম আর আই...
আমার কথার উপর ও কথা বলে,
"স্যার কার কাছে যেতে হবে? আমি জিগ্গেস করছিনা আমি ভালো হব কিনা শুধু একটা বাচ্চা যদি হয়ে যেতো মানে তালে।গেলেও শান্তি, এমনিও আর এই শালা বিকল শরীর টাকে টানা যাচ্ছে না মানে কোনো মতে দায়িত্ব গুলো মিটিয়ে...."🚨
আমি চুপ করে থাকি। গলা পাকায় আমার। ছোট্ট বাচ্চা একটা মেয়ে, ওর বর ও আজকে আসেনি। আমি বলি ," আজ যে কটা ওষুধ দিলাম খাস। আর ওই ডাক্তার বাবু কি বললো জানিয়ে জাস। দরকার পড়লে সময় ভাবিস না। ফোন করিস."
ও চলে যায়। যাওয়ার আগে চোখ ফুটো হয়ে কল বেরোচ্ছে ওর। নিজের সব রিপোর্ট আজ নিজে নিয়ে এসেছে। ও বাড়িতে কি বলবে তাও জানিনা। ও জানে ওর জট পাকানো শরীরে এবারে বড়ো জন্তু শিকার বসিয়েছে। আমি কেমন থমকে যাচ্ছি। উন্মাদের মতন ফোন করলাম ওর বর কে। সব জানিয়ে দেবো? আমার ইউনিটএর সাইকোলজিস্ট কে জানাই। ওর এবারে কাউন্সিলিং লাগবে ।লড়াই এর কাউন্সিলিং। নতুন লড়াই। ও জিতে যাবে জানি কিন্তু এই না মেলা হিসেব গুলো আমাকে...
যাক, ডাইরি টা আজ এখানেই শেষ করি। হয়তো এর পর একদিন ওর চুল পড়ে যাবে অথচ বেঁচে যাবে। নষ্ট কোষ যেনো শিষ্ঠ হয়। এটুকু ছাড়া ডাক্তারি বাবুদের প্রার্থনার খুব একটা কিছু নেই বোধয়!
রাত বারটায় মেয়েটা ফোন করে। আমি সবে খেতে বসেছি।
"স্যার বমি টা আর হচ্ছে না। ব্লিডিং টাও বন্ধ হয়েছে। কালকে যাবো স্যার ক্যানসার এর ডাক্তারের কাছে।"
"আচ্ছা। বেস্ট অফ লাক। ভয় পাস না। সব ভালো হবে।" আমি চুপ করে থাকি।
স্যার, আপনি চুল পড়ে গেলে, শরীরে কষ্ট হলে ওষুধ দেবেন তো, আর আমার লড়াই টা লিখে দেবেন স্যার। আমি জিতবো কিনা জানিনা কিন্তু অন্য কেউ এই লড়াই এ যেনো শক্তি পায় স্যার। লিখে দেবেনআপনি?🥺🥺🙏🙏
আমি ওকে কথা দিয়েছি । আমার সূক্ষ অনুভূতি গুলো আজও কেনো যে ভোঁতা হয়ে যায়নি! লিম্বিক সিস্টেম এ করাতের ঘা। রাত অনেক। ওর কথাই লিখে জানালাম সবাইকে। আপনারা যারা লড়াই করছেন প্লিজ হার মানবেন না হারার আগে🥺। ।© তীর্থ
আমার এই ভাঙাচোরা কাবু হয়ে যাওয়া রোগিনী টির দোহাই 🥺🙏
Image: An Immunoglobulin M.