19/06/2025
অনেকেই আমার কাছে জানতে চেয়েছেন যে বলিতে ছিন্ন করা মাথা দিয়ে দেবীর উদ্ধেশ্যে আরতি করার পর সেটাকে হোমগ্নীতে আহুতি দেওয়া হয় কেনো?
তন্ত্র অতি গুপ্ত বিষয় তার সেই গোপনীয়তা বজায় রেখে যেটুকু বলা যায় সেইটুকু তুলে ধরছি।
☠️ মা কল্যানেশ্বরী শক্তিপীঠ আশ্রম ☠️
তান্ত্রিক সাধনার একটি অত্যন্ত গোপন এবং ভয়ঙ্কর প্রথা হচ্ছে বলিতে ছিন্ন করা মাথা ব্যবহার করে দেবীকে আরতি করা এবং পরে সেই মাথাকে হোমে (অগ্নিকুণ্ডে) আহুতি দেওয়া। এই রীতির গভীরে রয়েছে বহুস্তরীয় তান্ত্রিক, কর্মতাত্ত্বিক ও দার্শনিক ব্যাখ্যা। নিচে এর কারণগুলি বিশদে বলা হলো:
🔷 ১. সাধনার ধরণ: কোন কোন তন্ত্রধারায় এই রীতি প্রচলিত?
এই প্রথা মূলত দেখা যায় নিচের তন্ত্রধারায়:
তন্ত্রধারা প্রধান দেবতা মাথা দিয়ে আরতির ব্যবহার
অঘোর/ মহাকালী, চামুণ্ডা, নিয়মিত, মাথা ও করোটি
কাপালিক ভবানী উভয়
ভৈরবী তন্ত্র চণ্ডী, ভৈরবী, মৃত্যুঞ্জয় সাধনায়
কুলকুণ্ডলিনী
ভূততন্ত্র / প্রেতরাজ, মহাকাল, আত্মার খোলা সাধনায়
প্রেতসাধনা চন্ডভৈরব
চামুণ্ডা চামুণ্ডা, ধূমাবতী মারণক্রিয়ায় হোমে মাথা
মারণ তন্ত্র
এগুলোতে বলির জন্য ‘সঙ্কল্প-মন্ত্র’ বলা হয়, যেখানে সাধক তার শরীর/চেতনার প্রতিনিধিরূপে বলিদান করে।
🔴 ২. চেতনার চূড়ান্ত উৎসর্গ (Highest Sacrifice of Consciousness)
ছিন্ন মাথা হচ্ছে প্রাণ ও বুদ্ধির আসন। আরতি যখন মাথা দিয়ে করা হয়, তখন তার দ্বারা বোঝানো হয় যে উপাসক তার সমস্ত চেতনা, অহং, বুদ্ধি ও ইচ্ছাশক্তি দেবীর চরণে উৎসর্গ করছেন। এই উৎসর্গ আত্মবিসর্জনের সর্বোচ্চ রূপ।
তন্ত্রশাস্ত্রে “মস্তক” (মাথা) হল:
অহংকারের আসন,
বুদ্ধির কেন্দ্র,
পঞ্চপ্রাণের সংগ্ৰহস্থল।
একজন জীব যখন তার মাথা উৎসর্গ করে, সে তার সমস্ত ইন্দ্রিয়, চেতনা ও আত্মপরিচয় দেবীর চরণে সঁপে দেয়।
এই আরতি মানে —
🔺 "আমি কেবল আলো বা ধূপ দিচ্ছি না, আমি আমার অস্তিত্বের দীপ্তিকে তোমার পদতলে সঁপে দিলাম।"
🔥 ২. হোমে আহুতি – রূপান্তরের প্রক্রিয়া (Transmutation through Fire)
তান্ত্রিক দৃষ্টিতে, অগ্নি হলো রূপান্তরকারী শক্তি। ছিন্নমস্তক বা বলির মাথা যখন হোমে দেওয়া হয়, তখন সেটি:
কর্মফলের দহন করে,
জীবাত্মার মোহ-মায়া বিচ্ছেদ ঘটায়,
এবং এটিকে দেবীশক্তিতে রূপান্তর করে।
এটি একপ্রকার কর্মসংহার তন্ত্র, যেখানে বলির মাধ্যমে একটি জীবনের কর্ম ও সত্তাকে মুক্ত করে দেওয়া হয়।
ছিন্নমস্তক দিয়ে আরতির পর সেটিকে হোমে দেওয়ার অর্থ:
মৃত ইন্দ্রিয়/চেতনার দেহকে অগ্নির মাধ্যমে দেবীচৈতন্যে রূপান্তর করা
এটি তামসিক মোহ, ভয়, মৃত্যুচিন্তা, পুনর্জন্মচক্র ভাঙার প্রক্রিয়া।
হোমমন্ত্র:
“অয়ং মস্তকং, চেতনা-বিন্দু-সহিতং।
অগ্নি-তেজে বিনাশয়, কালিমূর্তে লীন কুরু।
স্বাহা।”
হোমে আহুতি দেওয়া মানে: “আমার আত্মপরিচয়, আমার সীমিততা — সব কিছু তোমার মহাশক্তিতে বিলীন হোক”।
🕯️ ৩. আরতি = চেতনার আলো, মাথা = চেতনার আধার
উপাদান প্রতীকার্থ
ছিন্ন মাথা সর্বোচ্চ ত্যাগ, মোহ-ভঙ্গ
মাথা দিয়ে আরতি চেতনার দীপ্তি উৎসর্গ
হোমে ফেলা রূপান্তর ও কর্মদহন
রক্ত প্রাণশক্তি
হাড় মুলতত্ত্ব (Earth Tattva)
চোখ চেতনার দ্বার
যখন মাথা দিয়েই আরতি করা হয়, তখন এটি অন্তর্চেতনার আলোকে বাহিরে এনে দেবীর সামনে প্রকাশ করা। এটি বোঝায় – “আমার মধ্যে যা কিছু রয়েছে, সেটাই তোমার পায়ে উজাড় করে দিলাম।
ছিন্নমস্তক দিয়ে আরতি করার ক্রম (রাত্রীবেলায়)
১. অষ্টচামর বা শবচক্র স্থাপন
২. ছাগবলি/মেষবলি/ মহিষবলি ইত্যাদির ছিন্নমস্তক
৩. প্রাণপ্রতিষ্ঠা মন্ত্রঃ
“অয়ং মস্তকং দেব্যৈ জীবনরূপে প্রতিস্থাপয়ামি স্বাহা”
৪. ছিন্নমস্তক দ্বারাই প্রদীপের আগুনে চারদিক আরতি
৫. মন্ত্রঃ
“অহংকারং সর্বং ত্যক্ত্বা, চেতসা অর্পয়ামি।
কালীমুখে আরতিং কুর্বে, মম জ্ঞানং প্রসীদ তু।।”
📋 ৪. গ্রন্থভিত্তিক ভিত্তি (Scriptural Basis)
🔶 "কালিতন্ত্র" – মহাকালীর উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে:
"মস্তকং চ চেতসা দত্ত্বা যঃ করেৎ আরতিম্ভবং।
স দেব্যাঃ অনন্তকল্পে লভেৎ চ শ্রীচরণং ধ্রুবম্॥"
অর্থ: যিনি চেতনাসমেত মাথা উৎসর্গ করে দেবীর আরতি করেন, তিনি অনন্তজন্মেও দেবীর চরণ লাভ করেন।
🔶 "ভৈরব-তন্ত্র" ও "কাপালতন্ত্র":
হোমে ছিন্নমস্তক দান মানেই আত্মসত্তার অগ্নিযাত্রা, যেখানে পুরাতন কুলষ, জন্মস্মৃতি, ইন্দ্রিয় তৃষ্ণা ভস্ম হয়।
🩸 ৫. রক্ত এবং প্রাণশক্তির দেবীমুখে উৎসর্গ (Offering of Prana to Kali or Chamunda)
বিশেষত কালী, চামুণ্ডা, ভৈরবী, ধূমাবতী ইত্যাদি উগ্র দেবীর পুজোয়, রক্ত ও মাথা সরাসরি তাঁর খাদ্যরূপে গ্রহণীয়। কিন্তু হোমের মাধ্যমে সেই রক্ত/মাথা অগ্নিতে নিবেদনের ফলে:
দেবী সত্বর তুষ্ট হন,
তান্ত্রিক শক্তি প্রতিবন্ধকতা ছিন্ন করে প্রবাহিত হয়।
🧿 ৬. মৃত্যুকে জয় করার প্রক্রিয়া (Facing and Subduing Death)
মাথা বলির প্রতীক মানে জীবনের সবচেয়ে বড় ভয় – মৃত্যু। একে দেবীমূর্তির সামনে আরতির মাধ্যমে ব্যবহার করার অর্থ:
মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া,
তাকে দেবীর আলোয় নিঃশেষিত করা,
এবং শেষে হোমে আহুতি দিয়ে মৃত্যুকেই দেবীর প্রসাদে রূপান্তর করা।
🧘♂️ ৭. সাধকের অবস্থান ও অভিপ্রায় (State of the Sadhaka)
এই প্রক্রিয়া সাধকের ৩টি অভ্যন্তরীণ স্তরে কাজ করে:
১. তামসিক সত্তার দমন:
মোহ, কাম, লোভ — এগুলোর মূল আসন মাথা ও মগজ। মাথা উৎসর্গ মানেই তা ধ্বংস।
২. মৃত্যুভয়ের অতিক্রম:
ছিন্নমস্তক হ’ল “মৃত্যু”র রূপ। তাকে স্পর্শ করে, আরতি করে এবং হোমে ফেললে সাধক মৃত্যুকে জয় করে।
৩. শূন্য অভিজ্ঞতা (Void Realization):
এই সাধনায় বোধ হয় – “আমি কিছুই নই, দেবীই সব”।
🧿 ৮. প্রেতচক্র ও আত্মার মুক্তি (Spirit Wheel and Moksha)
তান্ত্রিক মতে, মাথা ছিন্ন হলে আত্মা শ্বাসপথ/নাসারন্ধ্র দিয়ে বের হয়। আরতি করার সময় তা দেবীর মুখচক্রে প্রবেশ করে।
এই সময় প্রেতচক্র খুলে যায় এবং সেই আত্মা:
দেবীতে লীন হতে পারে, বা
সাধকের অধীন শক্তিপুরুষ হয়ে ওঠে (তান্ত্রিক ব্যবহার)
এইজন্য বিশেষ নকশায় আঁকা "ভৈরব মণ্ডল" ও "প্রেত যন্ত্র" স্থাপন করা হয়।
🔷 ৯. চক্র ও শক্তিপথ: চেতনার যাত্রাপথ এই সাধনায়
এখানে কুণ্ডলিনী শক্তি উঠে যায় মুলাধার → সহস্রার → শূন্য পর্যন্ত, যেখানে সাধক “আমি” সত্তাকে গলাটির নীচে কেটে ফেলে:
মুলাধার: বলির রক্তধারা থেকে উদ্ভূত প্রাণশক্তি
স্বাধিষ্ঠান: কামশক্তির নিয়ন্ত্রণ (প্রাণরক্ষা)
অজ্ঞাচক্র: ভয় ও মৃত্যুভঙ্গ
সহস্রার: চেতনার বিস্ফোরণ
🔐 ১০. কার্যকারিতা ও ফল (Energetic Effects)
ফলাফল ব্যাখ্যা
দেবী দ্রুত তুষ্ট কারণ প্রাণশক্তি সরাসরি উৎসর্গ
তামসিক, ভয়, মানসিক দুর্বলতা বিলীন।
প্রতিবন্ধকতা নাশ।
তান্ত্রিক সিদ্ধি লাভ বিশেষত: বশীকরণ, মারণ,
চেতনা-সঞ্চার।
হোমের মাধ্যমে অতীতের পাপ বা দুঃসহ স্মৃতি
কর্মদহন। পুড়ে যায়।
ভূত/প্রেতসাধনা কারণ মাথা দিয়ে আরতি করলে
কর্মদহন। ভূচক্র দ্রুত সচল হয়।
🛑 ১১. সতর্কতা ও নিষেধ
এটি অত্যন্ত উচ্চতর এবং বিপজ্জনক সাধনা। এর জন্য প্রয়োজন:
দীক্ষা ও গুরু অনুমতি,
উপযুক্ত রক্ষামন্ত্র ও কবচ,
প্রেতশক্তি নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা।
সাধারণ ব্যক্তি বা কৌতূহলী অনুশীলক এ থেকে দূরে থাকাই উচিত, কারণ এতে চেতনার ভারসাম্য ভেঙে আত্মবিকৃতি ঘটতে পারে।
🕉️ ১২. তান্ত্রিক নিয়ম ও শর্ত পূরণ
এই সাধনায় কুণ্ডলিনী শক্তি নিচ থেকে উপরে ওঠে মাথা পর্যন্ত। ছিন্নমস্তক প্রতীক যা বোঝায়:
মাথা = সাহসিক ত্যাগ ও আত্মসমর্পণ
অগ্নি = কর্মের দহন ও রূপান্তর
দেবী = সর্বগ্রাসিনী চেতনা
এই রীতি বিশেষভাবে দেখা যায়:
কাপালিক, অঘোর, ভৈরবী তন্ত্রসাধনায়, যেখানে দেবী কেবল রক্ত বা প্রাণ চায় না, বরং পূর্ণ তনু-বুদ্ধি-আত্মা চায়।
সাধক এখানে শুধু বলিদান করেন না, বরং নিজেকে বলি হিসেবে প্রস্তুত করেতে পারেন। মাথা দিয়ে আরতি ও হোম সেই সাধকের পরিপূর্ণ আত্মউৎসর্গের প্রতীক।
🔻সংক্ষেপে:
ছিন্ন মাথা দিয়ে আরতি = "আমি আমার বুদ্ধি, চেতনা, অহংকার সব কিছু তোমার পায়ে দিলাম।"
হোমে আহুতি = "এই উৎসর্গ অগ্নিতে দহন হোক, এবং দেবীশক্তিতে রূপান্তরিত হোক।"
⚠️ গুরুত্বপূর্ণ টীকা:
এটি একটি অতি গোপন ও বিধিবদ্ধ প্রথা, শুধুমাত্র অঘোর, কাপালিক ও মাণ্ডলিক তন্ত্রসাধকদের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। সাধারণ ব্যক্তিদের এ থেকে দূরে থাকা উচিত। কারণ এর বিপরীত প্রতিক্রিয়াও ভয়ঙ্কর হতে পারে যদি উপযুক্ত অনুমতি, সংযম, এবং অভিজ্ঞতা না থাকে।
Tantrik Sadesh Acharya