
07/08/2025
*শিশুকে খাবার গেলাবেন না*
*সে খেতে শিখুক*
ডাঃ পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায়
শিশু চিকিৎসক শিশুকে সাধারণত ছমাস বয়সে ভারি খাবার খাওয়ানো শুরু করতে বলেন। তার মূল কারণ হলো, ততদিনে শিশু অনেকখানি বেড়েছে। সুতরাং শুধুমাত্র দুধ থেকে সে তার প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায় না। এই তরল থেকে অর্ধ তরল ও ভারি খাবার শুরু করার কালটা ঝক্কির। তাই অভিভাবকদের কতগুলো বিষয়মনে রাখতে হবে।
--তরল খাবার খাওয়া ও ভারি খাবার
খাওয়া পদ্ধতিগত ভাবে এক নয়। কারণ তরল খাবার যেমন ঢক করে গলায় সেঁধিয়ে দেওয়া যায়,ভারি খাবারের ক্ষেত্রে সেরকম সম্ভব নয়। তাকে মুখের ভিতর নাড়াচাড়া করে চিবিয়ে লালা মিশিয়ে অর্ধ তরল করে তারপর গেলা সম্ভব হয়। এটা শিশুর কাছে একটা নতুন শিক্ষা, সুতরাং তাকে শিখতে হয়। সময় লাগে।
--আপনার কাজ হলো সেই শেখাতে তাকে সাহায্য করা। ভারি খাবার আপনি যদি পিষে অর্ধ তরল করে বাটি চামচ দিয়ে গিলিয়ে দেন, তাতে কিন্তু তার শিক্ষাটা বিলম্বিত হয়। সুতরাং ধৈর্য্য রাখুন। এক থেকে দেড় মাসে সে শিখে যাবে। চেষ্টা করুন বসিয়ে খাওয়াতে। ধরে নিন প্রথম প্রথম সে কিছুই পারবে না।
--খাবার পিষে খাওয়ালে আরো একটা ঝুঁকি হলো, খাবারের মাধ্যমে শরীরে সংক্রমণ প্রবেশ করানো। ব্লেন্ডার, মিক্সি বা ছাঁকনি যা দিয়েই আপনি খাবার ছাঁকুন না কেন, সে খাবারে জীবানু ঢুকবে। কারণ ওগুলো স্বাস্থ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে আপনি দূষনহীন করছেন না।
--আমাদের দেশের অভিভাবকেরা আরো একটা ভুল করেন। নবজাতককে দুঘন্টা বা আড়াই ঘন্টা পর পর খাওয়াতে থাকা তাঁরা এটা ভুলে যান বা মানতে চান না যে শিশু বড় হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে বড় হচ্ছে তার পাকস্থলী। কমছে খাদ্য পাকস্থলী থেকে নিচে নামার গতি। তাই ছমাস, এক বছর বয়স হয়ে গেলেও তাঁদের শিশুকে দু থেকে আড়াই ঘন্টা পর পর খাওয়ানোর উৎসাহ কমে না। এতে করে শিশুর অর্ধেকটা খালি হওয়া পেটে তাঁরা টার্গেট পূরণ করার মতো খাবার ঠুসতেই থাকেন। এতে শিশুর খাবারের প্রতি ভীতি জন্মায় অথবা সে বাড়তি খাবার বের করে দেয়। তাঁরা ভাবেন শিশুর বদহজম হয়েছে বলে সে বমি করছে।
--তাছাড়া শক্ত খাবারের ক্যালোরি ভ্যালু অনেক বেশি। সেগুলোর নামতে সময় লাগে বেশি। সুতরাং দুটো খাবারের মাঝে ব্যবধান ধীরে ধীরে বাড়াতে হবে। যে শিশু শক্ত খাবার খেতে শিখে যায় তার দৈনিক চার থেকে পাঁচবার খাবার পরিমাণ মতো দিলে যথেষ্ট।
--শিশু স্বর্গ থেকে নেমে আসা ঈশ্বর বা দেবদূত নয়, সে আপনাদের পরিবারের। আপনাদেরই একজন। সুতরাং তার জন্য স্পেশ্যাল কিছু তৈরি করার দরকার নেই। আপনার ডাল, আপনার ভাত, আপনার মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, দই, ছানা, মাখন, রুটি, সুজি ,চিঁড়ে, ছাতুতে তার দিব্যি পুষ্টি হবে, যদি আপনি চিকিৎসকের কাছে জেনে নেন কোন খাবারটা কতখানি দিতে হবে।
-- সুতরাং সিনথেটিক খাবার, আমন্ড,কাজু, কিসমিস, মাখানা, গাদা গাদা ভিটামিন, ইত্যাদি আপনার সখপূরণের বিষয়, শিশুর দরকারের নয়।
-- শিশু শিশু হলেও মানুষ। তারও জিভে স্বাদগ্রন্থি আছে। সেও চায় বিভিন্ন খাবারের স্বাদ আলাদা আলাদা ভাবে নিতে। সুতরাং ভাত ডাল ভাজা তরকারি মাছ আলাদা আলাদা ভাবে রাখুন, যেভাবে আপনারা খান। খাবারে যেন স্বাদ থাকে। খাবার খেয়ে শিশুর যেন মনে না হয় যে সে ওষুধ গিলছে।
--যত কম বয়সে সম্ভব, শিশুকে নিজেদের সঙ্গে খাওয়াতে বসুন। খাওয়ার মধ্যে সামুদায়িক ব্যাপারটা থাকলে শিশু খেতে উৎসাহ পায় বেশি। সেটাকে তার টাস্ক বা শাস্তি মনে হয় না।
--আপনাদের এলাকায় যেসব খাবার সহজলভ্য সেসব খাবারই শিশুর খাদ্য হিসাবে নির্বাচন করুন। দু মাইল দূরে গিয়ে শিশুর জন্য শিঙ্গি মাগুর মাছ বা কাঁঠালি কলা কেনার দরকার নেই। তাজা রুই, কাতলা, এমনকি তেলাপিয়া বা শিঙ্গাপুরি কলাও খাদ্য হিসাবে এদের সমকক্ষ।
--শিশুর একঘেঁয়ে লাগতে পারে বলে রোজ রোজ খাবারে নতুনত্ব আনার ভুল করবেন না। এত ভ্যারাইটি হয় না এটা শিশুকে বুঝতে দিন। আপনি যেমন শেখাবেন সে তেমন শিখবে। এই সিগন্যালিংটা করুন। নতুবা পায়ে হাঁটতে একঘেয়েমি হচ্ছে বলে হাতে হাঁটছি, ব্যাপারটা ঠিক সেরকম হবে।
-- আর প্লীজ প্লীজ প্লীজ, শিশু খাচ্ছে না বলে তাকে মোবাইল বা টিভি দেখিয়ে খাওয়াবেন না। তাহলে সব বরবাদ। সে খাবারের প্রতি অমনোযোগী হয়ে উঠবে তাতে। সেই খাবার গেলাতে হবে আপনাকে। সে শিখবে না। মনে থাকে যেন।
--মনে রাখবেন, শিশুকে খাওয়ানো আপনার টার্গেট ফুলফিল করা নয়। বরং শিশুর নিজে খেতে শেখাটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। প্যাসিভ ফিডিংয়ের বদলে অ্যাকটিভ ফিডিং অর্থাৎ আপনার খাওয়ানোর থেকে শিশুর নিজের খাওয়া আজ থেকে আপনার টার্গেট হোক।
ছবি গুগল থেকে সংগৃহিত।