10/06/2025
❝ লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন..❞ এই প্রবাদটি এখনও বাংলার মাঠে-ঘাটে, শহরের অলিতে-গলিতে বহু লোকের মুখে শোনা যায়। পশ্চিমবঙ্গে গৌরী সেনের নাম জানে না, এরূপ লোক বিরল। কিন্তু জানেন কি এই গৌরী সেন কোনো কল্পনা নন আদপেই একজন রক্তমাংসের মানুষ.. এ বাংলারই সুসন্তান..!🩷🌻
ষোড়শ শতাব্দীর শেষে হুগলী শহরের অন্তর্গত বালি নামে এক পল্লীতে জন্মগ্রহণ করেন গৌরী সেন। তাঁর সম্পূর্ণ নাম গৌরী শঙ্কর সেন। তিনি জাতিতে ছিলেন সূবর্ণ বণিক। তাঁর আদিনিবাস সম্পর্কে দুটি ভিন্ন মত রয়েছে। তিনি হুগলীর অন্তর্গত বালি গ্রামের অধিবাসী ছিলেন, কিন্তু অনেকে আবার বহরমপুরের অধিবাসী বলেন। যদিও তিনি কখনও বহরমপুরের অধিবাসী ছিলেন না।
পর্তুগিজদের আমলে যে সকল দেশীয় ব্যবসায়ী উল্লেখযোগ্য ছিল তাদের মধ্যে এক ব্যবসায়ীর নাম আজও প্রবাদ হিসাবে উল্লেখ করা হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য, ধর্মকর্ম, জনকল্যাণ মূলক কাজে এই মানুষটি বর্তমান প্রজন্মের কাছে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখযোগ্য। তিনি গৌরী সেন..❤️
তাঁর পূর্ব পুরুষ পুরন্দর সেন সপ্তগ্রামের পতনের পর পুরন্দরের বংশধর হলধর সেন হুগলীতে এসে বসবাস করেন। সেইসময় পর্তুগিজরাই ছিল, হুগলীর শাসনকর্তা, ইংরেজ শাসন তখনও এদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। হলধর-এর প্রপৌত্রের নাম ছিল অনিরুদ্ধ সেন, অনিরুদ্ধের পুত্রের নাম নন্দরাম। আর নন্দরামের পুত্র হল গৌরী সেন।
প্রথমেই বলে রাখি, কলকাতার বিখ্যাত প্রাচীন অধিবাসীদের মধ্যে বৈষ্ণবচরণ শেঠ সর্বাপেক্ষা পুরাতন লোক ছিলেন। প্রায় একশো বছর আগে বড় বাজারে তাঁর বাসস্থান ছিল। তাঁর সময়ে যে সমস্ত লোক ব্যবসা বাণিজ্য করতেন তাঁদের মধ্যে বৈষ্ণব বাবু একজন অত্যন্ত পরায়ন এবং ধনী ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর সম্বন্ধে অনেক গল্প আছে। তেলঙ্গানার রাজকুমার রামরাজা কলকাতা থেকে দেবারাধনার জন্য যে গঙ্গা জল নিয়ে যেতেন, সেই গঙ্গা জল বৈষ্ণব চরণের মোহরাঙ্কিত না হলে তিনি ব্যবহার করতেন না।
এই গৌরী সেন ব্যবসার সূত্রে বৈষ্ণব চরণের অংশীদার ছিলেন। বৈষ্ণব শেঠ এক সময়ে অনেক দস্তা কেনেন। কিন্তু পরীক্ষা করে জানা যায়, এই দস্তার মধ্যে রূপোর অংশ ছিল বেশী। সেই সময় বৈষ্ণব চরণ ভাবলেন, গৌরী সেনের নামে দস্তা কেনার ফলে ❝ রাঙ্গের বদলে রূপায় ❞ এসে দাঁড়িয়েছে। এরপর ধর্মভীরু, কর্তব্য পরায়ন বৈষ্ণব চরণ সবকিছু বিক্রি করে সমস্ত টাকাই গৌরী সেনকে দিয়ে দেন।
গৌরী সেন অসাধারণ সৌভাগ্য সম্পদের অধীশ্বর ছিলেন, তাঁর প্রতি সৌভাগ্য দেবীর আকস্মিক কৃপা সম্বন্ধে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে। বাংলার প্রথম গির্জা ব্যান্ডেল চার্চের দেওয়ান ছিলেন গৌরী সেন। গৌরী সেনের পিতা নন্দরাম ছিলেন মধ্যবিত্ত গৃহস্থ। মূলত ১৫৯৯ খ্রীঃ ব্যান্ডেলে এই গির্জা নির্মাণ করা হয়। খ্রীষ্টানদের উপাসনা করার জন্য এটি তৈরি করা হয়..🌷
একবার তিনি সাতটি নৌকা বোঝাই করে মেদিনীপুরে দস্তা পাঠান। নৌকাগুলি যখন মেদিনীপুরে এসে পৌঁছায় তখন তাঁর বন্ধু ভৈরব চন্দ্র দত্ত নৌকাগুলি রৌপ্য পূর্ণ দেখে তাঁর জিনিস নয় বলে তিনি আবার হুগলীতে গৌরী সেনের কাছে নৌকাগুলি ফেরত পাঠিয়ে দেন।
জনশ্রুতি আছে, যেদিন নৌকাগুলি হুগলীতে ফিরে আসে ঠিক তার আগের রাতে তিনি স্বপ্ন দেখেন যে, মহাদেব তাঁর সামনে এসে তাঁকে বলছেন যে, তুমি মহাদেবের মন্দির নির্মাণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলে। তার জন্য আমি তোমায় অর্থ পাঠিয়েছি। তুমি কাল নৌকা থেকে তা গ্ৰহণ করে তোমার বাড়ির পশ্চিমদিকের বাগানে আমার মন্দির করে দিও। পরেরদিন সকালেই গৌরী সেন গঙ্গাতীরে গিয়ে দেখেন সপ্ততরীর যাবতীয় দস্তা রৌপ্যে পরিণত হয়েছে। তাই দেখে তিনি বিস্মিত হয়ে গেলেন।
এরপর তিনি সেই অর্থ ব্যয় করে মহাদেবের জন্য মন্দির প্রতিষ্ঠা করলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ❝গৌরীশঙ্কর মন্দির❞ হুগলীতে বিদ্যমান আছে। মন্দির গাত্রে একটি প্রস্তর ফলকে মন্দির প্রতিষ্ঠার তারিখ লিখিত আছে-
গৌরী সেন, বাংলা সন ১০০৬ সাল, ইংরেজি সন ১৫৯৯ সাল।
সেই সময় সপ্তগ্রামের সমস্ত খাবারের দোকানে তিনি বলে দিয়েছিলেন যে, তাঁর নাম করে কোন দরিদ্র ব্যক্তি যদি খেতে চান, তাহলে তাকে যেন খেতে দেওয়া হয়। কিন্তু তাঁর এই দানশীলতার সুযোগ নিয়ে অনেকেই তাঁর অর্থ অপচয় করত। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি কখনও ক্ষুন্ন হতেন না। তিনি ছিলেন বিনয়ী, ধীর ও সদালাপী ব্যক্তি। এরপর গৌরী সেন তাঁর অর্জিত বিপুল সম্পত্তি দান করতে থাকেন। কন্যাদায়, মাতৃদায়, পিতৃদায়, দেনার দায়ে যারা জর্জরিত, আবার যারা ন্যায় পথে থেকে সৎকার্যের জন্য ফৌজদারীতে জড়িত ও জরিমানার আসামী, তাদের জন্য তিনি অর্থ ব্যয় করতেন।
এই থেকেই শুরু হয় সেই বিখ্যাত প্রবাদবাক্য — ❝ লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন..❞💛🌿
গৌরী সেনের বংশধররা এখনও হুগলীতে বিদ্যমান আছেন। কিন্তু আগের মতো সে অর্থ তাঁদের আর নেই। বর্তমানে শ্রী সত্যচরণ সেন, গৌরী সেনের বংশে বর্তমান আছেন। গৌরী সেনের প্রাসাদোপম বিরাট ভবন আজও আছে, কিন্তু তিনি যে গৃহে জন্মগ্রহণ করেন তা আর নেই। যদিও তাঁর প্রতিষ্ঠিত গৌরী শঙ্করের মন্দির রয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে কোন ব্যবস্থা করা হয় নি। এমনকি গৌরী সেনের নামে একটি রাস্তার নামও করা হয় নি..🍁
♦️তথ্যসূত্রঃ কলিকাতা একালের ও সেকালের (হরিসাধন মুখোপাধ্যায়)
সংকলনে ✒️ স্বপ্নাশিষ দেবনাথ