26/10/2025
অটিজম-একজন বাবা, একজন ডাক্তার,একজন সংগঠকের মনের কথা।
লিখলেন ডাঃ রুদ্র সিনহা
যখন প্রথম আমার ছেলের অটিজমের ডায়াগনোসিস পেলাম, তখন আমার বয়স ছিল ৩৫। আমাদের ডাক্তারদের জীবনে এই সময়টায় সাধারণত পড়াশোনা, ট্রেনিং শেষ করে ক্যারিয়ার শুরু করার বয়স। জীবনের নিয়ন্ত্রণ যেন তখনই হাতে আসছে — এমন এক সময়।
আমি স্বীকার করি, পরের দুই বছর আমি গভীরভাবে বিচলিত ছিলাম — একজন বাবা হিসেবে, এবং আরও বেশি একজন ডাক্তার হিসেবে। বুঝতে অনেকটা সময় লেগেছিল যে এই ডায়াগনোসিস কোনও “সমস্যা” নয়, যেটা সময়ের সঙ্গে বা ওষুধে সেরে যাবে। এটা আজীবনের সঙ্গী — আমার সন্তানের, এবং আমাদের সবার।
মা, বাবা, ছেলে — এই তিনজনের সঙ্গে আর এক পরিচয় জুড়ে গেল, অটিজম।
একটা সত্য আমরা প্রতিটি বাবা-মা মনে মনে জানি — একটাই প্রশ্ন আমাদের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাড়া করে বেড়ায়:
“আমরা না থাকলে আমাদের সন্তানের কী হবে?”
এই প্রশ্নের কোনও পেশা নেই, কোনও শ্রেণি নেই, কোনও ধর্ম বা মতাদর্শ নেই।
আপনি ডাক্তার হন, ব্যবসায়ী হন, শিক্ষক, কর্মচারী বা সমাজসেবী; আপনি হিন্দু, খ্রিস্টান, মুসলিম বা নাস্তিক; রাজনৈতিকভাবে বাম, ডান বা মধ্যপন্থী — শেষ পর্যন্ত সবাই একই জায়গায় এসে দাঁড়াই।
দুই বছর সেই মেনে নেওয়ার লড়াই চলেছিল। তারপর বুঝতে পারলাম, যখন আমি আমার ছেলেকে নিজের মতো করে থাকার জায়গা দিলাম, বোঝার চেষ্টা করলাম — তখন ও একেবারে শান্ত। মেল্টডাউন, বিহেভিয়ার — সব যেন গলে গেল। চার বছর বয়সে ওকে সাধারণ স্কুল থেকে তুলে নিয়ে একটি স্পেশাল স্কুলে ভর্তি করলাম। তখন আমরা স্কুলকে বলেছিলাম —
“ও যদি খুশি মনে স্কুলে যেতে চায়, যাবে। যদি না চায়, জোর করব না।”
এই সময় আমি অনেক রিসার্চ করলাম, আর জানলাম — অটিজমের কোনও নিরাময় নেই।
এটা সারাজীবনের।
তখনই একটা শান্তি এল — যদি কোনও “চিকিৎসা” নেই, আর যদি আমার সন্তান সুখে থাকে নিজের জগতে, তাহলে ওকে “রোগী” হিসেবে দেখা কি আদৌ যুক্তিযুক্ত?
হয়তো এটা জীবনের অন্য এক ধরণ, অন্য এক দৃষ্টিকোণ।
একটা সময় বামহাতি হওয়াকেও “বিকৃতি” বা “অসুখ” মনে করা হত।
আজ কে খেয়াল রাখে কে কোন হাতে লেখে?
তৃতীয় উপলব্ধিটা ছিল — অটিজমকে মেডিকেল মডেলে নয়, সামাজিক মডেলে বোঝা দরকার।
ডাক্তার বলে আমার পূর্বধারণা ছিল চিকিৎসার দিকে। কিন্তু অভিজ্ঞতা শেখাল, যতই আমরা বয়স্ক হই, ততই বুঝি — থেরাপি বা ওষুধের বাইরে, আমাদের সন্তানের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে সমাজের গ্রহণযোগ্যতার উপর।
আমাদের প্রয়োজন এমন এক সমাজ, যেখানে অটিস্টিক মানুষরা নিজেদের মতো করে জায়গা পাবে — গ্রহণযোগ্যতা ও অংশগ্রহণের সুযোগ নিয়ে।
কিন্তু আমরা প্রায়ই উল্টোটা করি — আমরা তাদের ঘিরে রাখি, আলাদা করি, চিকিৎসার নাম করে সীমাবদ্ধ করে ফেলি।
চতুর্থ উপলব্ধি এল বন্ধুদের কাছ থেকে। অনেকে সদিচ্ছা নিয়ে বলেছিলেন, “বিদেশে চলে যাও — ওখানে সুবিধা বেশি।”
আমি বিদেশের অনেক পেরেন্টস গ্রুপে যোগ দিলাম — ইউকে, ইউএস, অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু দেখলাম, ওরা কি সত্যিই ভালো আছে?
বরং উল্টো — বেশি একাকীত্ব, সরকারি নিয়ন্ত্রণ, পরিষেবার রেশনিং, আর খরচ অন্তত পাঁচগুণ বেশি।
কলকাতা আর ভারত বরং অনেক মানবিক।
এখানে সহানুভূতি আছে, পরিষেবা আছে, আর ক্রমবর্ধমান দক্ষতা আছে।
আর এই গতিতে, আগামী পাঁচ থেকে দশ বছরের মধ্যে, আমরা বিশ্বের সেরা মানের অটিজম সাপোর্ট সিস্টেম তৈরি করতে পারব — আমি বিশ্বাস করি।
আর শেষ উপলব্ধিটাই ছিল সেই বীজ, যেখান থেকে অটিজম কনভেনশন জন্ম নিল।
আমরা যত সম্পদই রেখে যাই না কেন, যত আত্মীয়ই প্রতিশ্রুতি দিক, যত নাম বা জনপ্রিয়তাই অর্জন করি — কিছুই সত্যিকার অর্থে আমাদের সন্তানের উপকারে আসবে না, যদি না আমরা একে অপরের সন্তানের পাশে দাঁড়াই।
আজ আমাদের নিজেদেরকে প্রশ্ন করতে হবে — আমরা কি সত্যিই এমন একজন অটিজম শিশুর বা প্রাপ্তবয়স্কের পাশে দাঁড়াচ্ছি, যাদের বাবা-মা আর নেই? তাহলে আমরা কীভাবে আশা করতে পারি, যে অন্য বাবা-মা আমার সন্তানের পাশে দাঁড়াবেন যখন আমরা আর থাকব না? এটাই সত্যি। এবং এটাই সমাধান।
এটি আমাদের সম্মিলিত দায়িত্ব,
কারণ আমাদের সন্তানদের যত্নে আর কেউ নেই — শুধু আমরা।
হয়তো অন্য কোনও পথও আছে — আমরা সবাই মিলে তা খুঁজে নিতে চাই।
মঞ্চ এখন প্রস্তুত, আর কিছু দিন অপেক্ষা।