08/08/2025
' আমার একটু থাইরয়েড আছে । একবার থাইরয়েডের ওষুধ শুরু করলে সারা জীবন খেতে হবে। 'লোকের মনে নানা প্রশ্ন থাকে যার সঠিক উত্তর খুঁজে পাওয়া যায় না। ডাঃ ত্রিবর্ণা সিনহা চক্রবর্তী সেই প্রশ্নের উত্তরগুলো লিখলেন।
।। থাইরয়েড এবং থাইরয়েড ফাংশন টেস্ট – নিয়ে প্রয়োজনীয় কিছু কথা।।
🔹এন্ডোক্রাইন সিস্টেমের সমস্যাগুলোর মধ্যে থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যা খুবই কমন — বলা যায়, ডায়াবেটিসের পরেই এর স্থান।
🔹থাইরয়েড গ্রন্থির রোগ কিন্তু জন্মের পরপরই (Newborn stage) দেখা দিতে পারে । আবার প্রবীণ বয়সেও হতে পারে।
অর্থাৎ, শিশু থেকে বৃদ্ধ — কেউই একে এড়াতে পারে না।
🔹পরিসংখ্যান বলছে, মেয়েদের মধ্যে এই সমস্যা পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি দেখা যায়। হরমোনজনিত পরিবর্তন, গর্ভাবস্থা, পিরিয়ড ও মেনোপজ — এসব কারণে মহিলারা বেশি ঝুঁকিতে থাকেন।
◾ কিন্তু ভালো খবরটা হোলো...
👉🏻থাইরয়েড সমস্যার ডায়াগনোসিস খুব সহজ । খুব সাধারণ রক্তপরীক্ষা (TSH, T3, T4) দিয়েই বোঝা যায়।
👉🏻 এবং এর চিকিৎসাও খুব সহজলভ্য ও কার্যকর । শুধু নিয়মিত ওষুধ আর ফলো-আপ করলেই যথেষ্ট।
◾ যদি সময়মতো ধরা পড়ে এবং নিয়ম মেনে চিকিৎসা করা যায়, তাহলে একেবারে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা সম্ভব । প্রতিদিনের কর্মক্ষমতা, পড়াশোনা, গর্ভধারণ,কোনো কিছুতেই সমস্যা হয় না।
◾আমরা সবাই জানি—থাইরয়েড গ্রন্থি গলার সামনে থাকা ছোট্ট একটা প্রজাপতির মতো দেখতে গ্ল্যান্ড।
এই গ্ল্যান্ড থেকে নিঃসরণ হয় দুটি গুরুত্বপূর্ণ হরমোন —
T4 (Thyroxine) এবং T3 (Tri-iodothyronine)।
◾ এই হরমোন আমাদের শরীরের প্রত্যেকটি কোষে কাজ করে । শরীরের মেটাবলিজম নিয়ন্ত্রণ করে,
অর্থাৎ:🔹শক্তি উৎপাদন,🔹 হৃদস্পন্দন, 🔹দেহের তাপমাত্রা,🔹হজম প্রক্রিয়া,
🔹মুড ও মানসিক স্বাস্থ্য,🔹হাড়ের স্বাস্থ্য,
🔹এমনকি কিডনি ফাংশনও এই হরমোনের প্রভাবে চলে।
◾তাই, থাইরয়েড গ্ল্যান্ড যদি বেশি কাজ করে (Hyperthyroidism), বা কম কাজ করে (Hypothyroidism), তাহলে তার প্রভাব পড়ে শরীরের প্রায় প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে।
ক্লান্তি, ওজন বেড়ে যাওয়া, চুল পড়া থেকে শুরু করে ডিপ্রেশন, হজমের গোলমাল — এসবের পেছনে কখনো কখনো থাকে এই ছোট্ট গ্ল্যান্ডটার গলদ।
◾থাইরয়েড রোগ মানেই কি Hypo বা Hyper? চলুন একটু বুঝে নিই...
“আমার থাইরয়েড আছে”—এই কথা আমরা প্রায়ই শুনে থাকি।
আসলে বেশিরভাগ সময়েই এর মানে বোঝায় Hypothyroidism, কারণ এই অবস্থাটা এতটাই কমন যে, ‘থাইরয়েড’ শব্দটা শুনলেই আমরা "হাইপোথাইরয়ডিজম " কেই বুঝি।
কিন্তু বাস্তবটা একটু ভিন্ন।
👉 Hypothyroidism আর Hyperthyroidism — এই শব্দদুটো কোনো নির্দিষ্ট রোগের নাম নয়।
এগুলো আসলে রক্তে থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা কমে গেছে (Hypo) বা বেড়ে গেছে (Hyper) — এই অবস্থা বোঝায় ।
◾ অর্থাৎ, এগুলো হলো রোগের উপসর্গ বা ফলাফল, আসল রোগটা এর পেছনে লুকিয়ে থাকে — যেমন:
🔹Hashimoto's thyroiditis
🔹Graves’ disease
🔹পিটুইটারি সমস্যা
🔹গ্ল্যান্ডে টিউমার বা অন্যান্য অস্বাভাবিকতা।
তবে ঠিক আছে, এগুলো নিয়ে আলোচনাটা একটু জটিল হতে পারে —
তাই আজ আমরা প্রচলিত ও সহজভাবে বোঝা যায় এমন কিছু দিক নিয়েই কথা বলি।
◾এবার, অনেকেই বোঝেন, গলার কাছে ফুলে গেলে, তবেই থাইরয়েডের সমস্যা হয়।
কিন্তু, বাস্তব টা তা নয়। গ্ল্যান্ড না ফুলে গেলেও থাইরয়েড সমস্যা থাকতে পারে।
◾Hypothyroidism-এর উপসর্গ :
Hypothyroidism-এর উপসর্গগুলো অনেকটাই নন-স্পেসিফিক — মানে, এগুলো অন্য অনেক রোগেও হতে পারে। তাই রোগটা সহজে চোখে পড়ে না।
👉 লক্ষণগুলো কী কী হতে পারে?
🔹সবসময় ক্লান্তি লাগে
🔹শরীর যেন ভালো লাগে না,
🔹মন খারাপ বা অবসাদ (ডিপ্রেশন),
🔹অলসতা বেড়ে যাওয়া,
🔹ওজন বেড়ে যাওয়া,
🔹ঠান্ডা সহ্য হয় না,
🔹চুল পড়ে, ত্বক শুষ্ক হয়ে যাওয়া,
🔹পিরিয়ড অনিয়মিত হয়ে পড়া...ইত্যাদি।
◾এই উপসর্গগুলো কম বেশি প্রায় সকলেই জানেন।
কিন্তু ...অনেকেই এসব উপসর্গকে গা সওয়া করে ফেলেন —
ভাবেন, "আচ্ছা... স্ট্রেসের জন্যই হবে হয়তো! " বা "একটু ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট খেলেই ঠিক হয়ে যাবে ! "....
কিন্তু এগুলো যদি হাইপোথাইরয়েডিজমের ইঙ্গিত হয়, তাহলে আর দেরি না করে একটা রক্ত পরীক্ষা (TSH, T3, T4) করিয়ে নেওয়াই ভালো।
🔹 কারণ?
এই রোগের ডায়াগনোসিস যেমন সহজ, তেমনি চিকিৎসাও খুব কার্যকর।
কিন্তু যদি পরীক্ষাই না করান, তবে রোগটা ধীরে ধীরে গোটা শরীরের মেটাবলিজমকে ধ্বংস করে দিতে পারে। তাই সন্দেহ হলে, চুপ না থেকে রক্ত পরীক্ষা করুন।
বাঁচান নিজের শরীর ও মানসিক স্বাস্থ্য।
◾ অন্যদিকে Hyperthyroidism এর একটু কম দেখা যায়। তবে এর উপসর্গ গুলো comparativelySpecific : যেমন অতিরিক্ত ঘাম, ওজন কমে যাওয়া, হৃদস্পন্দন দ্রুত হওয়া, হাত কাঁপা,ঘুম কম হওয়া, চোখ উঁচিয়ে আসা (Graves’ disease).. ইত্যাদি।
◾Thyroid Function Tests:
আমরা সবাই জানি, থাইরয়েড টেস্ট মানেই TSH, T3, T4।
কিন্তু এই টেস্টগুলোর আসল সম্পর্ক আর ব্যাখ্যাটা কি ?
🔹TSH (Thyroid Stimulating Hormone) কী কাজ করে?
TSH এক ধরনের হরমোন, যা তৈরি হয় আমাদের মস্তিষ্কের পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে।
এর মূল কাজ হলো থাইরয়েড গ্ল্যান্ডকে সক্রিয় করে তোলা, যাতে সেটি যথাযথ পরিমাণে T3 (Tri-iodothyronine) এবং T4 (Thyroxine) হরমোন ক্ষরণ করে।
আবার রক্তে T3 ও T4 যখন পরিমিত পরিমাণে থাকে, তখন শরীর ফিডব্যাক মেকানিজম-এর মাধ্যমে TSH-এর উৎপাদন কমিয়ে দেয় — যেন হরমোনের ভারসাম্য ঠিক থাকে।
◾ তাই, গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, TSH-এর মাত্রা সবসময় T3 ও T4-এর সঙ্গে উল্টো পথে চলে।
উদাহরণ দিয়ে বুঝলে সহজ হবে:
👉🏻 Hypothyroidism হলে:
TSH বেড়ে যায়⬆️ আর T3, T4 কমে যায়⬇️
👉🏻 Hyperthyroidism হলে:
TSH কমে যায় ⬇️ আর T3, T4 বেড়ে যায়।⬆️
🔹 তাহলে তিনটেই একসাথে কেন করা হয়?
কারণ, শুধুমাত্র TSH দেখে সব সময় রোগের সম্পূর্ণ চিত্র বোঝা যায় না।
T3 ও T4-এর রিপোর্ট না থাকলে বুঝতে অসুবিধা হয় যে—
👉 সমস্যাটা থাইরয়েড গ্ল্যান্ডে, না কি পিটুইটারি গ্রন্থিতে।তাই টেস্ট করাতে গিয়ে শুধু TSH নয়, অনেক সময় T3 ও T4 রিপোর্টও গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
◾ তবে কিছু ক্ষেত্রে শুধু Serum TSH করাই যথেষ্ট। যেমন...
🔹 Screening Test:
যখন জানতে চাই একজনের থাইরয়েড স্বাভাবিক (Euthyroid) কিনা।
🔹 Newborn Screening:
নবজাতকের মধ্যে Hypothyroidism ধরা পড়লে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা যায়।
🔹 Treatment Follow-up:
Hypothyroid রোগীদের T4 রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি চলছে কিনা, তার ফলাফল বোঝার জন্য।
◾থাইরয়েড টেষ্ট সংক্রান্ত কিছু Myths and Facts ::
1)Thyroid টেষ্ট করতে কি Fasting blood sample লাগে?
উত্তর - না।
থাইরয়েড টেস্টের জন্য Fasting blood sample প্রয়োজন নেই, তবে Blood সকালে দিলে ভালো।
2) টেস্টের দিন ওষুধ খেলে রিপোর্ট খারাপ হবে ? ✅ আংশিক সত্য। সকালের ডোজ নিলে T4 কিছুটা বেড়ে যায়, তাই রক্ত দেওয়ার আগে ওষুধ খাবেন না। রক্ত দেবার পর খেতে পারেন।
3) শুধু TSH করলেই চলবে ?
সব সময় নয়, অনেক ক্ষেত্রে T3 ও T4 করার দরকার।
4) থাইরয়েড মানেই সারাজীবন কষ্ট ? একদমই না।
ওষুধ খাওয়া মানে শরীরে হরমোনের স্বাভাবিক মাত্রা বজায় রাখা, যাতে অন্য অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। অনেক ওষুধ ই তো সারাজীবন খেতে হয়, যেমন প্রেশার, সুগার এর ওষুধ ।
5) থাইরয়েড থাকলে গর্ভধারণ সম্ভব নয় ?
একেবারেই ভুল ধারণা।
নিয়মিত চিকিৎসায় সুস্থ সন্তান জন্ম সম্ভব।
◾ টেস্টের দিন কি করণীয়?
🔹সকালে রক্ত দিন । দিনের বেলায় TSH সামান্য পরিবর্তিত হয় (Circadian rhythm), তাই সকালে টেস্ট করা ভালো।
🔹রক্ত দেওয়ার আগে থাইরয়েডের ওষুধ খাবেন না।
🔹অন্য ওষুধ (BP, ডায়াবেটিস) সাধারণত চলতে পারে।
🔹হাই ডোজ বায়োটিন, স্টেরয়েড, অ্যামিওডারন, লিথিয়াম নিলে ডাক্তারকে অবশ্যই জানান।
◾ মনে রাখবেন:
🔹থাইরয়েড সমস্যার প্রাথমিক পর্যায়ে উপসর্গ খুব স্পষ্ট নাও হতে পারে। কিন্তু নিয়মিত চেকআপ করলে সহজেই ধরা পড়ে ও চিকিৎসায় একদম স্বাভাবিক থাকা যায়।
🔹আর একটা কথা, যারা ওষুধ খাচ্ছেন, তারা নিজে নিজে ওষুধ বন্ধ বা ডোজ পরিবর্তন করবেন না। নির্দিষ্ট গ্যাপ এ রক্ত পরীক্ষা করুন আর চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
◾ আবার এমন কিছু পরিস্থিতি আছে যেখানে থাইরয়েড টেস্টের ফলাফল ভুল ব্যাখ্যা হতে পারে।
যেমন:
🔹 অসুস্থ শরীর (Non-thyroidal illness): বিভিন্ন কারণে (ইনফেকশন, অপারেশন, স্ট্রেস ইত্যাদি ) শরীর অসুস্থ থাকলে TSH, T3, T4-এর স্বাভাবিক সম্পর্ক পাল্টে যেতে পারে।মানে রিপোর্টে গন্ডগোল আসতে পারে । অথচ থাইরয়েড ঠিকই আছে !
🔹গর্ভাবস্থা:
প্রথম তিন মাসে হরমোনের ওঠানামা স্বাভাবিক। এসময় TSH একটু কমে গেলেও দুশ্চিন্তার কিছু নাও হতে পারে।
🔹ওষুধের প্রভাব:
বায়োটিন, স্টেরয়েড, ডোপামিন, লিথিয়াম, এন্টিসিজার ওষুধ — অনেক ওষুধ TSH বা T3-T4-এ হস্তক্ষেপ করতে পারে।
🔹সাপ্রেসড পিটুইটারি (Secondary Hypothyroidism):
এই ক্ষেত্রে TSH স্বাভাবিক বা কম থাকে, অথচ T4 , ও কম! তাই অনেক সময় শুধু TSH দেখে মিস হয়ে যায়।
সংক্ষেপে:
থাইরয়েড টেস্ট ব্যাখ্যা করার আগে তাই সবসময় রোগীর ওষুধের তালিকা, সাম্প্রতিক অসুস্থতা, গর্ভাবস্থা, আয়োডিন গ্রহণ ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় মাথায় রাখা প্রয়োজন।
সে কারণে ,সবসময় একজন চিকিৎসকের পরামর্শে রক্ত পরীক্ষা করা এবং রিপোর্ট দেখিয়ে পরামর্শ নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।