25/05/2025
কাল ছিল বিশ্ব সিজোফ্রেনিয়া দিবস। এই রোগটাকে নিয়ে লিখলেন ডাঃ অনিকেত চ্যাটার্জি
আজ সিজোফ্রেনিয়া নিয়ে কিছু কথা হবে। 'অনেক কথা' হবে না, কারণ লোকজন রোগটার কথাই জানে না। এই ফেসবুকের জনতা কিছুটা নাম শুনেছে, কিছুটা সিনেমায় দেখেছে, কিন্তু সেটাও ভাসা ভাসা একটা আইডিয়া। কেউ এই রোগকে 'মাল্টিপল পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার' বলে মনে করে, কেউ শুধু 'hearing voices' এর কথা জানে, কেউ হয়তো হ্যালুসিনেশন এর কথা বলবে। আর ফেসবুকের বাইরে? জানেই না বেশিরভাগ লোকজন! 😅
অথচ, সিজোফ্রেনিয়া রোগে আক্রান্ত মানুষ আমরা সবাই দেখেছি। কোথায় দেখেছি বলুন তো? দেখেছি আমাদের পাড়ায়, পাড়ার রাস্তার মোড়ে, বেপাড়ার রাস্তায়। যাদেরকে আমরা 'পাগল' বলি, 'উন্মাদ' বলি — তাদের অনেকেই সিজোফ্রেনিয়াতে আক্রান্ত।এই রোগের ট্রিটমেন্ট আছে, সঠিক ট্রিটমেন্টে নিরাময় আছে, নিরাময়ের পর সুস্থ জীবনযাপন আছে, কিন্তু তারা সেই সুযোগটা পায় না। তাদের পরিবার পাশে থাকে না, ভয়-লজ্জা-ঘেন্না-হতাশায় তাদের রাস্তায় ঠেলে দেয়, দরকারী সামান্য সাপোর্টটুকুও দেয় না, রাস্তার জীবন কাটাতে বাধ্য করে — কারণ তারা রোগটা সম্পর্কে কোনো ধারণাই রাখে না। সবাই ভাবে, 'পাগল' এর কোনো ট্রিটমেন্ট নেই। কিন্তু আছে।
তার আগে আসুন, একটু রোগটা নিয়ে কথা বলি। হ্যাঁ, সিজোফ্রেনিয়া সাইকায়াট্রিক রোগগুলোর মধ্যে Severity এর দিক দিয়ে অন্যতম বড় একটা রোগ। কী হয় এতে? বুলেট পয়েন্টে বলি —
১. মস্তিষ্কের কিছু নির্দিষ্ট সার্কিটে (স্নায়ুজালে) ডোপামিন নামের নিউরোট্রান্সমিটার বেড়ে যায়। (এটা সবচেয়ে বেসিক থিয়োরি, যার উপরে ভিত্তি করে ট্রিটমেন্ট হয়। বাকি উঁচুস্তরের থিয়োরি বলতে গেলে অনেক কিছু বলতে হবে।)
২. এর থেকে তৈরি হয় ডিলিউশন (Delusion) ও হ্যালুসিনেশন (Hallucination)। ডিলিউশন মানে ফিক্সড ভ্রান্ত ধারণা।
কেউ মনে করে, কেউ তার পেছনে নজর রাখছে।
কেউ মনে করে, পুলিশ/আর্মি/গুণ্ডারা তার ক্ষতি করতে চায়, পেছনে পড়ে আছে।
কেউ মনে করে, ঘরের লোকজন তাকে বিষ খাওয়াতে চায়।
কেউ মনে করে, পাশের বাড়ির লোক তার সম্পত্তি নিয়ে তাকে মেরে ফেলতে চায়।
হ্যাঁ, Delusion of Persecution (নির্যাতন সম্পর্কিত ভ্রান্ত ধারণা) সিজোফ্রেনিয়াতে খুব কমনভাবে দেখা যায়। অন্যান্য যে ডিলিউশনগুলো দেখা যায়, সেগুলো হলো Delusion of reference (সবকিছুই ভাবে নিজেকে সংক্রান্ত), Delusion of Nihilism (ভাবে আমার জীবনে সব শেষ, আমি মরে যাবো) ইত্যাদি ইত্যাদি।
এর সঙ্গেই জুড়ে যায় Hallucination (মূলতঃ auditory)। অর্থাৎ—
ক) রোগী কানের কাছে শুনতে পায়, তাকে নিয়ে কেউ সবসময় খারাপ কথা বলে যাচ্ছে।
খ) রোগী শুনতে পায়, তার দৈনন্দিন কাজ নিয়ে কেউ কানের কাছে running commentary করে যাচ্ছে।
গ) রোগী শুনতে পায়, তার মনের চিন্তাগুলো কেউ তার কানের কাছে বলে যাচ্ছে।
ঘ) রোগী শুনতে পায়, অনেকজন মিলে তার কানের কাছে তাকে নিয়ে বদনাম/কেচ্ছা করে যাচ্ছে।
এই delusion ও hallucination মিলে রোগী দিশেহারা হয়ে ওঠেন, রেগে যান, ভয় পেয়ে যান, নিজেকে নিচু নজরে দেখতে শুরু করেন। তার সঙ্গেই চিন্তা করার ক্ষমতা ঘেঁটে যায় (Disorganised thoughts), হ্যালুসিনেশনের উত্তর দিতে শুরু করেন একা একা বিড়বিড় করে (self muttering), দৈনন্দিন কাজকর্ম করতে পারেন না (Decreased self-care), কাছের লোককে গালিগালাজ করতে থাকেন। ঘরের বা আশেপাশের লোকেরাও ভয় পেয়ে যান, চিকিৎসা সম্ভব সেটা ভুলে যান অনেক ক্ষেত্রেই।
কিন্তু চিকিৎসা আছে। ভয় না পেয়ে, আশা না ছেড়ে, চিকিৎসা চালাতে হবে। সঠিক চিকিৎসাতে মানুষ আগের জীবন ফিরে পান প্রায় সব ক্ষেত্রেই। যে ১-২%ক্ষেত্রে পুরোপুরি উন্নতি হয় না, সেক্ষেত্রেও প্রায় স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন, জীবিকার মাধ্যমে উপার্জন করতে পারেন, স্বাভাবিক সম্পর্ক মেইনটেন করতে পারেন।
আজ, ২৪শে মে, বিশ্ব সিজোফ্রেনিয়া দিবসে স্যার ফিলিপ ফিনেলের কথা মনে রাখুন। Sir Philippe Pinel (Father of modern psychiatry) এর জন্যই সিজোফ্রেনিয়া রোগীরা আজ আর অ্যাসাইলামে শেকল বাঁধা অবস্থায় থাকে না। বাড়িতে বা হাসপাতালে রোগীর সম্মান রক্ষা করে চিকিৎসা হয়, তারপর বাড়িতে ফিরে যান রোগী, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন।
Psychiatry বিভাগের একটাই উদ্দেশ্য — রোগীকে সম্মানের সঙ্গে চিকিৎসা করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে সাহায্য করা।
আসুন, শপথ নিই, সচেতনতা বাড়াই। 😊