10/12/2025                                                                            
                                    
                                                                            
                                            বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস ২০২৫
মানসিক চাপমুক্ত পরিবেশ নার্সদের   দক্ষতা বাড়ায়
লেখক: ছৈয়দ আহমদ তানশীর উদ্দিন
সারাবিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে ১৯৯২ সাল থেকে প্রতিবছর ১০ অক্টোবর ‘বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস’ পালন করা হয়।বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস প্রথম ১০ অক্টোবর, ১৯৯২ তারিখে ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেন্টাল হেলথ দ্বারা আয়োজিত হয়েছিল। এটি একটি বিশ্বব্যাপী মানসিক স্বাস্থ্য সংস্থা, যা ১৫০টিরও বেশি দেশে উপস্থিত রয়েছে। উদ্যোগটি ১৯৯২ সালে বিশ্ব ফেডারেশনের ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল রিচার্ড হান্টার প্রস্তাব করেছিলেন। ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত কোনো নির্দিষ্ট থিম ছাড়াই দিবসটি পালিত হতো। এটি প্রথমে মানসিক স্বাস্থ্যের সাধারণ সমস্যা সম্পর্কে মানুষকে শিক্ষিত করার ওপর জোর দেয়। পরবর্তী কালে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য বিশ্ব ফেডারেশনের তৎকালীন মহাসচিব ইউজিন ব্রডির পরামর্শে দিবসটি ১৯৯৪ সালের থিমের ওপর ভিত্তি করে পালিত হয়েছিল। থিম ছিল 'বিশ্বব্যাপী মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবার মান উন্নয়ন'। বিশ্ব ফেডারেশন মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, এর প্রতিরোধ এবং মানসিকভাবে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য আরো ভালো সুযোগ, সহায়তা তৈরি করতে প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট থিম ঘোষণা করে। ২০২৫ সালের বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের থিম হলো: Access to Services-Mental Health in Catastrophes. বাংলা পরিভাষায়, পরিষেবার সুযোগ - বিপর্যয় ও জরুরি পরিস্থিতিতে মানসিক স্বাস্থ্য
যা সংকটের সময় সময়োপযোগী এবং কার্যকর সহায়তার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে
মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার কারণগুলো বহুমুখী, প্রায়ই জেনেটিক, জৈবিক, পরিবেশগত ও মনস্তাত্ত্বিক কারণগুলোর সংমিশ্রণ জড়িত। জেনেটিক ও বায়োলজিক্যাল ফ্যাক্টর অর্থাৎ কিছু মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার একটি জিনগত উপাদান থাকে, যা ব্যক্তিকে আরো সংবেদনশীল করে তোলে, যদি তার নির্দিষ্ট কিছু রোগের পারিবারিক ইতিহাস থাকে। উপরন্তু, মস্তিষ্কের রসায়নে ভারসাম্যহীনতা বা কাঠামোগত অস্বাভাবিকতা মানসিক রোগের কারণ হতে পারে। পরিবেশগত ও মনস্তাত্ত্বিক কারণ অর্থাৎ জীবনের অভিজ্ঞতা, যেমন ট্রমা বা অপব্যবহারের ইতিহাস, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার অন্যতম একটি প্রধান কারণ। কাজের চাপ, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং প্রিয়জন হারানোর পরিবেশগত কারণগুলোর উদাহরণ, যা মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোকে ট্রিগার বা বাড়িয়ে তুলতে পারে।
● দেশের মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের জরিপ:
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বাংলাদেশ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহযোগিতায় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ২০১৮-১৯ সালে দেশে জরিপ চালায়।
২০১৮-১৯ সালের জরিপ অনুযায়ী, দেশের ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক কোনো না কোনোভাবে মানসিক রোগে ভুগছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে ডিপ্রেশন (বিষণ্নতা) ও অ্যাংজাইটি (উদ্বেগ)। শিশু-কিশোরদের মধ্যে এ হার ১২ দশমিক ৬ শতাংশ। কিন্তু চিকিৎসা নিচ্ছেন খুবই কম সংখ্যক মানুষ।
জরিপে দেখা গেছে, আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ৯২ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক ও ৯৪ শতাংশ শিশু কখনই মানসিক স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আসেনি। তারা না খায় ওষুধ, না কাউন্সেলিং করেন।
●৭০ শতাংশ নার্সরা Discrimination শিকার হচ্ছেন :
আইসিএন-এর প্রধান নির্বাহী বলেন- স্বাস্থ্যকর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। ন্যাশনাল নার্সেস সমিতির সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে- নার্সদের ৭০ শতাংশ বলেছেন, তারা নানাভাবে সহিংসতা বা বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। এর ফলে তারা চরম মানসিক চাপে আছেন এবং মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সংকটে রয়েছেন। নার্সরা কর্মক্ষেত্রে ক্লান্তি, উদ্বেগ এবং অতিরিক্ত চাপের মতো মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো বেশি অনুভব করেন, কারণ তাদের দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, ঘন ঘন শিফটে কাজ করা, এবং রোগীর যত্নের জন্য অনেক সময় ধরে সেবা দিতে হয়। এই কাজগুলো তাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, যার ফলে বিষণ্ণতা ও উদ্বেগের মতো সমস্যা দেখা দেয়। 
বাংলাদেশে নার্সরা নানা বৈষম্যের শিকার হয়ে মানসিক চাপে ভুগছেন। সম্প্রতি এক গবেষণা বলছে, অনুপযুক্ত পরিবেশে কাজ করছে দেশের ৮৬ শতাংশ নার্স। কোলাহলমুখর, স্বল্প আলো, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও অপর্যাপ্ত বায়ুপ্রবাহের মধ্যেই তারা দিনের পর দিন কাজ করে যাচ্ছে। অথচ কর্মজীবনে ৭০ শতাংশ নার্সই পদোন্নতি পায় না। ১০ থেকে ২০ বছর ধরে পদোন্নতি না পাওয়া ওসব স্বাস্থ্যসেবা কর্মী নার্সিং পেশায় নিয়োজিত রয়েছে। এক পদে থেকেই বহু নার্সই অবসরে গেছে। পাশাপাশি অতিরিক্ত কাজের চাপ, প্রাতিষ্ঠানিক দ্ব›দ্বসহ বিভিন্ন কারণে তাদের পেশাগত চাপ তৈরি হয়। যা তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে। দেশের ৪টি বিশ্ববিদ্যালয় ও নার্সিং ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞদের পরিচালিত সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা যায়, পেশাগত কাজ করতে গিয়ে উদ্বেগ ও বিষণ্নতার মতো মানসিক ব্যাধিতে ভুগছে ৫১ শতাংশ নার্স। ৬০ শতাংশ নার্স মানসিকভাবে অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতির মধ্যে দিন পার করছে। শারীরিক বা পরিবেশগতভাবে দুর্বল অবস্থায় রয়েছে ৪২ শতাংশ। সামাজিকভাবে বিভিন্ন কার্যক্রম যুক্ত হতে পেরেছে মাত্র ৪৮ শতাংশ নার্স। আর ২০ শতাংশের মধ্যে বিষণ্নতা কাজ করছে।
●কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যের অগ্রাধিকার জরুরি :
আমরা দেখতে পাই মানসিক স্বাস্থ্য সেবার প্রয়োজন আছে এমন মানুষদের মধ্যে মাত্র ৮ ভাগ মানুষ সেবা নিতে পারছেন, ৯২ শতাংশই মানসিক স্বাস্থ্য সেবার বাইরে রয়ে যান। মানসিক স্বাস্থ্য সেবা খাতে আমাদের দেশে যে রিসোর্চের ঘাটতি আছে তা এতেই স্পষ্ট হয়। একইসঙ্গে যদি শিশু-তরুণদের চিত্র দেখি তাদের মধ্যে চিকিৎসা ঘাটতির পরিমাণ ৯৪ শতাংশ, মাত্র ৬ শতাংশ চিকিৎসা নিতে পারছেন।
আমরা কর্মক্ষেত্রকে চিন্তা করি আর্থিক নিরাপত্তার বিবেচনায়, কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি এতটা গুরুত্ব পায় না। মানসিক স্বাস্থ্য একটি স্টেট অব ওয়েল বিং, যেখানে আমরা জীবনকে কীভাবে খাপ খাইয়ে নেই, কীভাবে আমাদের অ্যাবিলিটিগুলোকে ব্যবহার করি, কীভাবে আমরা শিখি, শেখাটাকে কাজে প্রয়োগ করি এবং কীভাবে আমরা চারপাশের কমিউনিটিতে অবদান রাখি এই সব বিষয়গুলোই মানসিক স্বাস্থ্যের অংশ। এই মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি আমাদের চারপাশের কমিউনিটিতে অবদান রাখতে, সামগ্রিক বিষয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণে, সম্পর্কগুলোকে জোরালো করতে এবং বজায় রাখতে সাহায্য করে। 
কর্মক্ষেত্রে একজন কর্মীর মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা গেলে সেটা অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক উল্লেখ করে তিনি বলেন, সারাবিশ্বে ৬০ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো খাতে চাকরি করছেন। এদের মধ্যে ১৬ শতাংশের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা পরিলক্ষিত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি যেটা এসেছে তা হলো- অতিরিক্ত কাজের চাপ, যা একজন কর্মীর মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্থ করে এবং কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এক হিসাবে দেখা গেছে, কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার কারণে প্রতিবছর আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ এক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। কর্মক্ষেত্রের বাইরে এই ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয় ৩ ট্রিলিয়ন ডলার।
গবেষণা বলছে যদি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নিরসনে ১ ডলার বিনিয়োগ করা হয় তবে রিটার্ন আসে ৪ ডলার। খুবই সহজ একটি ব্যবসা। আপনি ১০০ টাকা বিনিয়োগ করলে ৪০০ টাকা রিটার্ন পাবেন। এরচেয়ে সহজ ব্যবসা আর কী আছে! কিন্তু তারপরও মানসিক স্বাস্থ্য সেবা খাতে বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হচ্ছে না। 
সর্বোপরি বলা হচ্ছে, কুসংস্কার ও সনাতন বিশ্বাসের দেয়াল ভেঙে এগিয়ে যেতে হবে আমাদের। মানসিক রোগীদের কর্মের সুযোগ দিতে হবে। উপার্জনক্ষম ব্যক্তি মানসিক স্বাস্থ্যের কারণে যেন অবহেলা বা অমানবিক সিদ্ধান্তের শিকার না হয় কর্তৃপক্ষকে ভাবতে হবে বিষয়টি। মানসিক চাপের সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে হবে কর্মীদের। 'স্ট্রেস রিলেটেড' সমস্যা থেকে " employee burnout" প্রতিরোধ করতে হবে।
●নার্সদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য আমরা নিম্নোক্ত কাজ করতে পারি-
১. নার্স স্বাস্থ্য সুরক্ষা কমিটি গঠন।
২. নার্স সংকট নিরসন অর্থাৎ রোগীর শয্যানুপাতে নার্সের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে পারলে কাজের চাপ কমবে, ফলে তাদের স্নায়ুবিক চাপও কমবে।
৩. কোনও নার্স মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হলে তাকে সাথে সাথে মেন্টাল হেলথ কাউন্সিলর দিয়ে কাউন্সিলিং করা এবং তার সমস্যা সমাধানে সহায়তা করা।
৪. নিয়মিত মানসিক স্বাস্থ্য চেক-আপ।
৫. নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর নার্সদের জন্য বিনোদনমূলক আয়োজন করা।
৬. কাজের ভিত্তিতে বিশেষ প্রণোদনা প্রদান করলে কাজের স্পৃহা বাড়বে।
যাঁরা জীবন বাজি রেখে আমাদের সুরক্ষার জন্য জীবানুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন, তাঁদেরকে ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করার সুযোগ রয়েছে। তাদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার সময় এই অনুপ্রেরণা সরকার কেন দিবে না?
কেন সব মানুষ হাসিমুখে আরো বেশি নার্সদের সুবিধার বিষয় মেনে নেবে না? আমি যার মন-প্রাণ জুড়ানো ভালোবাসা চাইবো, তারে তো ততোটাই ভালোবাসতে হবে প্রতিদানে।
পরিশেষে, ইতোমধ্যে নেয়া সকল প্রশংসনীয় উদ্যোগের জন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে নার্সদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রস্তাব রাখতেই পারি নীতি নির্ধারকদের কাছে। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য মানসিক স্বাস্থ্যকে সুরক্ষা করতে হবে। কারণ সুস্থ মনই উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয়টি অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক- নার্সিং কর্মকর্তা, জেলা সদর হাসপাতাল কক্সবাজার