10/02/2022
কোভিড টিকা কীভাবে কাজ করে?
আমাদের চারিদিকে নানান ধরনের জীবাণু ভরা, সেটা পরিবেশে কিংবা শরীরে। কিন্তু আমাদের শরীরের ভেতরে-বাইরে কিছু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আছে, যেটা বেশিরভাগ জীবাণুকে আটকে দেয়, রক্ষা করে ক্ষতিকর প্রভাব থেকে। যখন মানুষ কোনো অতি ক্ষতিকারক জীবাণুর সংস্পর্শে আসে বা যখন জীবাণু মানুষের প্রতিরক্ষা দেওয়াল ভেদ করে যায়, তখন রোগ হয় কিংবা মৃত্যু ঘটে। টিকা কীভাবে মানুষের শরীরে কাজ করে, তা জানার আগে বুঝা দরকার মানুষের মধ্যে থাকা সেই সুরক্ষা দেওয়াল কী এবং সেটা কীভাবে কাজ করে।
জীবাণুর বিরুদ্ধে যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্ষতিকারক জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে সেটাকে বলা হয় ইমিউন সিস্টেম। যেটা জীবাণুকে শরীরের ভেতরে ঢুকতে দেয় না আর ঢুকে পড়লে ধ্বংস করে দিতে পারে।
শরীরের ইমিউন সিস্টেম কাজ করে যেভাবে
কোভিড টিকার কার্যকারিতা বুঝার জন্য জানা দরকার, আমাদের শরীর কীভাবে অসুস্থতার বিরুদ্ধে কাজ করে। যখন করোনাভাইরাস আমাদের শরীরে আক্রমণ করে তখন এটা কয়েকগুণ বাড়তে থাকে। এর সংক্রমণ (ইনফেকশন) আমাদের অসুস্থ করে তোলে। স্বাভাবিকভাবেই, বাইরে থেকে কোনো রোগজীবাণু মানুষের শরীরে ঢুকে গেলে আমাদের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সক্রিয় হয়ে ওঠে।
ইমিউন সিস্টেম এই সংক্রমণ মোকাবেলায় বিভিন্ন রকমের মাধ্যম ব্যবহার করে। মানুষের ত্বক, এমনকি চোখের পানিও এই ইমিউন সিস্টেমের অংশ। আর রক্তে থাকে লৌহকণিকা (রেড সেল), যা টিস্যু ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গে অক্সিজেন প্রবাহিত করে আর রক্তের শ্বেতকণিকা (হোয়াইট সেল) সংক্রমণ প্রতিহত করে। আর বিভিন্ন ধরনের শ্বেতকণিকা বিভিন্নভাবে ভাইরাস মোকাবেলা করে।
এক ধরনের শ্বেতকণিকা জীবাণু আর মৃত ও মৃতপ্রায় সেলকে গিলে খায়, যেটাকে বলা হয় ম্যাক্রোফেইজ। ম্যাক্রোফেইজগুলো আক্রমণকারী জীবাণুকে হজম করে যে অংশ ফেলে রাখে তাকে বলা হয় অ্যান্টিজেন। আর আমাদের শরীর সেই অ্যান্টিজেনকে চিহ্নিত করে এবং ভাইরাসকে আক্রমণের জন্য অ্যান্টিবডিকে চালিত করে দেয়।
ইমিউন সিস্টেমের হয়ে প্রতিরোধকারী কোষ লিমফোসাইট (টি-সেল) শরীরে প্রবেশ করা অচেনা বস্তুকে দমন করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সংক্রামক কোষের অ্যান্টিজেনের সাথে সংযুক্ত হওয়ার চেষ্টা করে টি-সেল। সংক্রামক কোষে সফলভাবে সেঁটে যেতে পারলে টি-সেল থেকে এক ধরনের রাসায়নিক নিঃসৃত হয়, যা সেই জীবাণুকে ধ্বংস করে।
আমাদের শরীরে যখন কোনো জীবাণুর মুখোমুখি হয়, তখন এর সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে তার ইমিউন সিস্টেমের অস্ত্র ব্যবহার করে। আর সংক্রমিত হয়ে গেলে এই সিস্টেম মনে রেখে দেয়, এই রোগে বিরুদ্ধে কীভাবে প্রতিরোধ গড়তে হবে।
কোভিড টিকা কাজ করে যেভাবে
ভাইরাসের সংক্রমণটাকে অনুকরণের মাধ্যমে তৈরি করা হয় কোভিড টিকা। পরবর্তীতে সেটা শরীরে প্রবেশ করানো মাধ্যমে ওই অনুকরণীয় সংক্রমণ ইমিউনিটিকে উন্নত করতে সহায়তা করে। এই সংক্রমণ অসুস্থ করে তোলে না, বরং এটা ইমিউন সিস্টেমকে টি-সেল ও অ্যান্টিবডি তৈরিতে সহায়তা করে। কোনো কোনো সময় এই সংক্রমণ অনুকরণের (ইমিটেশন ইনফেকশন) প্রক্রিয়ার কারণে টিকা নেওয়ার পর জ্বরের মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে। এই ধরনের উপসর্গ দেখা দেওয়া একেবারেই স্বাভাবিক, কারণ ওই সময়টাকে শরীর ভাইরাসের মোকাবেলায় দ্রুততার সাথে অ্যান্টিবডি তৈরির কাজ করে।
শারীরিক প্রক্রিয়ায় এই ইমিটেশন ইনফেকশন যখন চলে যায়, তখনও এর স্মৃতি বা টি-সেল এবং বি-সেল থেকে যায়। এই প্রক্রিয়া ভবিষ্যতে ওই রোগের মোকাবেলা করে। সাধারণত এই টি-সেল ও বি-সেল তৈরিতে টিকা প্রয়োগের পর কয়েক সপ্তাহ লেগে যেতে পারে। ফলে টিকা নেওয়া পরেও মানুষের মধ্যে ভাইরাসের উপসর্গ দেখা যেতে পারে, কারণ সুরক্ষা বলয় তৈরিতে টিকা তেমন সময় পায়নি।
কোভিড টিকার ধরণ
টিকা আবিষ্কারের জন্য বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করে থাকেন। ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণকে টিকা কীভাবে মোকাবিলা করতে পারে, তার তথ্যের উপর ভিত্তি করে এই দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক করা হয়। প্রতিরোধের ক্ষেত্রে ভাইরাস কীভাবে সেলকে সংক্রমণ করে এবং ইমিউন সিস্টেম এটার প্রতি কেমন প্রতিক্রিয়া দেখায়, তা বিবেচনায় নেওয়া হয়। পাশাপাশি অঞ্চলভেদে ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া, টিকার মানুষের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা এবং ভাইরাসের বিভিন্ন ধরণকে মাথায় রাখেন তারা।
এমআরএনএ টিকা
এমআরএনএ টিকা তৈরি করা হয় কোভিড-১৯ আক্রান্তকারী ভাইরাস থেকে নেওয়া উপাদান থেকে, যা আমাদের সেলকে নির্দেশনা দেয় ভাইরাস প্রতিরোধী প্রোটিন তৈরির। তখন আমাদের শরীর চিহ্নিত করতে পারে, এই প্রোটিন এভাবে থাকার কথা নয় এবং শরীর নিজেই টি-সেল ও বি-সেল তৈরি করে। আর এই টি-সেল ও বি-সেল মনে রাখে কোভিড-১৯ সৃষ্টিকারী ভাইরাসকে কীভাবে প্রতিরোধ করতে হবে। এবং শারীরিক প্রক্রিয়ায় পরবর্তীতে ভাইরাসকে প্রতিহত করে।
প্রোটিন সাবইউনিট টিকা
এই টিকা তৈরির ক্ষেত্রে পুরো ভাইরাসকে না নিয়ে ভাইরাসে থাকা প্রোটিনের ক্ষতিকর নয় এমন অংশকে নেওয়া হয়। টিকা শরীরে প্রয়োগের পরে আগের মতোই আমাদের শরীর চিহ্নিত করতে পারে, এই প্রোটিনতো এভাবে থাকার কথা নয় এবং শরীর নিজেই টি-সেল ও বি-সেল তৈরি করে। আর এই টি-সেল ও বি-সেল মনে রাখে কোভিড-১৯ সৃষ্টিকারী ভাইরাসকে কীভাবে প্রতিরোধ করতে হবে। এবং শারীরিক প্রক্রিয়ায় পরবর্তীতে ভাইরাসকে প্রতিহত করে।
ভেক্টর টিকা
ভেক্টর টিকা তৈরির ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ সৃষ্টিকারী ভাইরাসের অংশ নেওয়ার পরিবর্তে অন্যান্য ভাইরাসের মোডিফাইড ভার্সন নেওয়া হয়। আর এই মোডিফাইড ভাইরাসের মধ্যে কোভিড-১৯ সৃষ্টিকারী ভাইরাসের উপাদানও থাকে। বিজ্ঞানের ভাষায় এটাকে বলা হয় ভাইরাল ভেক্টর। যখন ভাইরাল ভেক্টর আমাদের শরীরে প্রবেশ করানো হয়, তখন তার জেনেটিক উপাদান আমাদের প্রোটিন তৈরির নির্দেশনা দেয়, যেই প্রোটিন কোভিডের সাথে সম্পর্কিত। আর নতুনভাবে তৈরি হওয়া প্রোটিনের নির্দেশনা পেয়ে আমাদের শরীর আরও প্রোটিন তৈরি করতে থাকে, যা পরবর্তীতে টি-সেল ও বি-সেল তৈরির মাধ্যমে কোভিড সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা দেয়।